-Advertisement-

সলিসিটর অফিসের দোতালায় প্রশস্ত হল ঘর। মাসের প্রথম দিন সকালে হাজিরা খাতায় প্রনয় সেন,  পদ – শিক্ষানবীস লেখা কলামের পাশে সই করে হতাশাগ্রস্থ মনে রেকর্ড রুমের বাইরে নিজের ছোট বসার জাগায় দাঁড়ালাম। দু বছর হলো আইন পাশ করে কোলকাতার এই সলিসিটর অফিসে শিক্ষানবিস। আইন পাশের পরের উচ্চাশা অনেকদিন দুরাশায় পরিনত হয়েছে।দুপুরের অবকাশ কাটে গোলদিঘির ধারে মুড়ি চিবুতে চিবুতে অলস চোখে ট্রাম গাড়ী, মানুষের অবিরল যাতায়াত দেখে আর অফিসের পরে মেসের চিলে কোটার ঘরের এক চিলতে ছাদে আকাশের তারা গুনে।

সেদিন গোলদিঘি থেকে অফিসে ফিরতেই, বড় সাহেবের ঘরে জরুরী তলব । দুরু দুরু বুকে সাহেবের ঘরে ঢুকতেই তাঁর হাসি মুখ “প্রনয় কাজকর্ম সব ভালো লাগছে তো ?” – তারপরেই সামনের চেয়ারে বসার নির্দেশ, প্রথমে হকচকিয়ে গেলাম।তিনি সামনের ফাইলে চোখ বোলাতে বোলাতে বল্লেন – “তোমার কাজে আমাদের সবাই খুবই খুশি, আমরা ভাবলাম কোনো গুরত্বপূর্ণ কেসের সাথে যুক্ত করে তোমাকে পেশাগতভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে।অত ঘাবড়াবার দরকার নেই ভায়া । আমরা জানি তুমি পারবে ।” অপ্রত্যাশিত কথায় মুখের হাঁ বন্ধ করে জিজ্ঞাসা ছিল কি কাজ স্যার । তিনি বলেন “আমাদের পুরানো ক্লায়েন্ট পূর্বতন জমিদার রায় বাহাদুর ভবানী প্রসাদ রায়চৌধুরি , যদিও জমিদারি চলে যাওয়ার পর তাল পুকুরে আর ঘটি ডোবে না, তিনি ঠিক করেছেন উইল করবেন। আত্মীয়স্বজন আছে কিনা জানা নেই, তবে তাঁর অস্বাভাবিক খামখেয়ালি স্বভাবের জন্য, এক বহুকালের পুরানো পরিচারক ছাড়া আর কেউ তাঁর সাথে থাকেনা । ভবানী প্রসাদ বর্তমানে থাকেন বোলপুর থেকে ত্রিশ মাইল দুরে, উদ্ধারনপুরে তাঁর বসত বাড়িতে, বোলপুর থেকেই বাস পাবে।এই ফাইলে বিস্তারিত সব কিছু পাবে। এ্যাকাউন্টস থেকে কিছু টাকা অগ্রিম খরচপত্র নিয়ে সোমবার সকালে বেরিয়ে পড়। ভবানীবাবু কে আর্জেন্ট তার করে দিচ্ছি সোমবার তোমার পৌঁছনোর খবর দিয়ে ।”

সোমবার বোলপুরগামী ট্রেন হুস হুস করে শহরতলি ছাড়িয়ে শস্যশ্যামল মাঠের পাশ ধরে দ্রুতগতিতে চলেছে , সকালের ঠান্ডা হাওয়ার শীত শীত ভাব।

আগামীকাল রবিবার । ভাবলাম মেসে আজ আর কাল ফাইলটা পড়ে পরশু সকালে হাওড়া থেকে ট্রেন ধরব। সোমবার বোলপুরগামী ট্রেন হুস হুস করে শহরতলি ছাড়িয়ে শস্যশ্যামল মাঠের পাশ ধরে দ্রুতগতিতে চলেছে , সকালের ঠান্ডা হাওয়ার শীত শীত ভাব।জামাকাপড়ের ব্যাগ থেকে ফাইলটা নিয়ে উইল ও মোক্তারনামার খসড়ায় চোখ বোলাতে লাগলাম । ষ্টেশনে নেমে সাইকেল রিকশায় বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছে উদ্ধারনপুরের বাসের খোঁজ করতে মাথায় হাত,  শুনি সারা দিনে  দুটি বাস ওদিকে যায়, সকালের বাস ইতিমধ্যেই রওনা হয়ে গেছে আর পরের বাস ছাড়বে সেই বিকেল পাঁচটায় ।

বাসষ্ট্যান্ডের বিশ্রামাগারের বেঞ্চিতে সময় কাটিয়ে সময়মতো বাসে  উঠি। লজঝড়ে বাস, যাত্রী ওঠানামা করাতে করাতে চলেছে। সন্ধে হয়ে এসেছে,  দুপাশের ধুধু মাঠে স্তরে স্তরে কুয়াশা দিগন্ত ছুঁয়েছে। মাঝে মাঝে কিছু মাটির একতলা বা দোতলা বাড়ি। সান্ধ্যকালীন উনুনের হালকা ধোয়াঁর কুন্ডলী আর কুয়াশার মিলমিশ। বাসের দোলানিতে তন্দ্রাচ্ছন্ন।ড্রাইভারের সহকারীর ডাকে চমক ভাঙে । উদ্ধারনপুর এসে গেছে । তাড়াহুড়ো করে ব্যাগ হাতে আমি একা যাত্রী নেমে পড়তেই বাসটা ভাঙাচোরা রাস্তা ধরে, আওয়াজে চারদিক কাঁপিয়ে উধাত্ত হলো । চারপাশে কোনো দোকানপাট মানুষজন চোখে পড়ে না,  শুনশান নিঝুম। ভবানীপ্রসাদের বাড়ির হদিস পাই কোথায় ? ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটানিতে রাস্তার ধারে, দুরের কালো ঝুপসী গাছের নিচে ঝোপঝাড় মাথা দোলায়। নজরে পড়ে ঝোপঝাপের ফাঁকে, হাওয়ায় কাঁপা টিমটিমে আলো।দ্রুত পা চালাই। গাছের আড়ালে দরমার ছাউনির নিচে চা ও টুকটাক জিনিষের দোকান বন্ধ করার তোড়জোড়ে ব্যাস্ত এক বৃদ্ধ ।গলা খাঁকারি দিয়ে বলি “ উদ্ধারনপুরের ভবানীপ্রসাদ বাবুর বাড়ীটা কোনদিকে জানেন?” বৃদ্ধ মাথা তুলে আমার আগাপাশতলা জরিপ করেন “ কোলকাতা থেকে আসা হচ্ছে বোধহয়? কিন্তু শেষ বাস তো এখানে না থেমে চলে গেল। হরিহর ছিল এখানে, আপনি এলেন না ভেবে ঘর পানে হাঁটা দিল যে।” বুঝলাম বাস আমাকে ষ্টপেজের কিছুটা আগে ধান ক্ষেতের ধারে নামিয়েছে আর হরিহর, মনে হয় ভবানীবাবুর লোক। বিড়ম্বনায় পড়া গেল। চিন্তা করে বৃদ্ধ দোকানী বাইরে এসে বলেন “ সামনের বাঁহাতি রাস্তা ধ’রে শাল বন পেরিয়ে পোয়াটেক পথ সোজা গেলেই রাজাবাবুর বাড়ি নজরে আসবে। আলো আছে তো?” মনে পড়ে ব্যাগে টর্চ আছে বটে তবে ব্যাটারির হাল কি জানি না।ব্যাগ হাতড়ে টর্চটা নিয়ে, বৃদ্ধকে ধন্যবাদ জানিয়ে হাঁটা দিলাম তাঁর দেখান পথে, বাস রাস্তার থেকে নেমে প্রশস্ত সর্পিল মেঠো পথ যেন কোন অন্ধকার সুড়ঙ্গের ভিতরে চলে গিয়েছে।কিছুটা এগিয়ে দুপাশে শালের বনে অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে। বেশ ঠান্ডা। টর্চের মিয়ানো হলুদ আলো পথ দেখায়।রাস্তার দু’পাশে শাল গাছের নিচে কোমর সমান অন্ধকার ঝোপগুলিতে মিটি মিটি জোনাকির আলো।একটানা ঝিঁঝির তানের ওঠা নামা।টর্চের হলুদ আলোয়ে পথ চলি। হঠাৎই সামনে দেখি, রাতের আকাশের পটভূমিতে বিশাল বাড়ির সিল্যুয়েট। ছায়াবৃত বাড়ির ভেতর দু একটি আলোর বিন্দুর নড়াচড়া, জমিদার বাড়ি এসে গেল বোধহয়।

বাড়িটার সামনে আলোআঁধারি পরিবেশে বিশাল বন্ধ দরজা। ভেঙ্গে পড়া অবস্থা। কিছুক্ষন ধাক্কা দেওয়ার পর, দরজার ফাঁকফোকরের ভেতর দিয়ে কাঁপাকাঁপা আলোর আভাস। ঘসঘসে স্বরে “কে ?” শুনে বলি কোলকাতা থেকে আসছি। বিদঘুটে ধাতব আওয়াজে প্রায় ভেঙ্গে পড়া দরজার পাল্লা খুলে, মুখের কাছে লন্ঠন ধরল ধুতি গেঞ্জি পরিহিত অস্বাভাবিক রোগা প্রায় ছয় ফুট লম্বা মানুষ। লন্ঠনের আলোয় ঝকঝক করে তার ঠোঁটের ওপর ছড়িয়ে পড়া দাঁতের সারি। “ কোলকাতার উকিল বাবু ? আসতে আজ্ঞা হোক, কত্তামশাই এখনো ঘুমোন নি ।” বুঝলাম এই হল হরিহর। আমার ব্যাগটা হাতে নিয়ে লন্ঠনের আলো দেখিয়ে সারসের মত লম্বা পায়ে এগিয়ে চলে।আমি তাল রেখে অনুসরণ করি,

লন্ঠনের আলোয় ভাঙ্গাচোরা কিছু ঘর ও বড় আগাছাপূর্ণ উঠান পেরিয়ে চওড়া বারান্দা। কিছু তালাবদ্ধ ঘর পার হয়ে হরিহর দাঁড়ায় পর্দা ঝোলান একটি দরজায়। “কত্তাবাবু কোলকাতার উকিলবাবু এয়েচেন।“

লন্ঠনের আলোয় ভাঙ্গাচোরা কিছু ঘর ও বড় আগাছাপূর্ণ উঠান পেরিয়ে চওড়া বারান্দা। কিছু তালাবদ্ধ ঘর পার হয়ে হরিহর দাঁড়ায় পর্দা ঝোলান একটি দরজায়। “কত্তাবাবু কোলকাতার উকিলবাবু এয়েচেন।“ সম্মতিসূচক গলার আওয়াজ শুনে, হরিহর ঘরের ভেতর আমাকে নিয়ে আসে।ভবানিপ্রসাদ বাবু পুরনো ধাঁচের কারুকার্যে খোদিত চার ছত্রি বিশাল খাটে তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসে, পুরনো আসবাবপূর্ণ বড় আয়তনের ঘরটি দুটো লন্ঠনের আলোতেও আলোআঁধারি। খাটের পাশের টেবিলে কয়েক দিস্তা হাতে লেখা কাগজের ডাঁই।এগিয়ে গিয়ে নমস্কার জানিয়ে অফিসের দেওয়া পরিচয় পত্রটির সাথে অন্যান্য কাগজপত্র তাঁর হাতে  দিয়ে আড়ষ্ট শরীরে দাঁড়িয়ে থাকি।চোখের উপর ঝুঁকে পড়া কাঁচাপাকা ভ্রুর ফাঁক দিয়ে তিক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার আপাদমস্তকে চোখবুলিয়ে গম্ভির কর্কশ স্বরে বলেন “রাত হয়ে গেছে।আজ বিশ্রাম নাও। হরিহর সব দেখিয়ে দেবে। কাল বেলা এগারটায় তোমার সাথে আলোচনা হবে।গ্রামে আজ ইলেক্ট্রিক নেই, আশা করি কাল সকালে এসে যাবে।” হরিহর ব্যাগটা তুলে ইঙ্গিতে আসতে বলে দরজার দিকে এগোয়ে। বারান্দায় বেরিয়ে হরিহরকে অনুসরণ করে সামনের দোতলায় যাওয়ার চওড়া কাঠের সিঁড়িতে ওঠার আগে, অল্পবয়সী শান্ত স্ত্রী কন্ঠে শুনি “ হরিহরদা রসুই ঘরে জল গরম করা আছে। গোসল ঘরে নিয়ে যেও।” আশ্চর্য হই, শুনেছিলাম ভবানীবাবু একাই থাকেন, তাহলে স্ত্রী কন্ঠের মালিকটি কে!যাক’গে এতে আমার কি আসে যায়।হরিহর দোতলায় বড় একটি ঘরে পৌঁছে, লন্ঠনটা রেখে চলে যায়। ব্যাগ থেকে রাতের জামাকাপড় বার করে, ঘরের বড় জানলাটার সামনে দাঁড়িয়ে বাইরে চোখ রাখি।দুরে বিন্দু বিন্দু আলো ছড়িয়ে আছে। মনে হয় গ্রামটি ওই দিকটাতেই।একটু পরেই হরিহর গরম জলের বালতি ঘরের লাগোয়া গোসল ঘরে রেখে যায়।জামাকাপড় পাল্টে আবার জানলাটার ধারে এসে দাঁড়াই।হরিহরের গলার আওয়াজে ফিরে দেখি, বিরাট এক ঢাকা দেওয়া কাঁসার থালা টেবিলে রাখছে।যাওয়ার সময় বলে রাতে নিচের বারান্ডায় থাকবে।খিদে পেয়েছিল বেশ, সাথে ঘুমও।তাড়াতাড়ি সব সেরে, শুয়ে পড়েছিলাম ঘরের বিশাল খাটে। জানলা দিয়ে আসা মৃদুমন্দ ঘুমপাড়ানি হাওয়ায় চোখ জুড়িয়ে আসে।ঘুমের আবেশে মনের আনাচ কানাচে ভাসে অদেখা মহিলার মিষ্টি স্বরকম্পের মাদকতা। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না।

পরদিন অভ্যাসমত ভোরে ঘুম ভাঙ্গে । ঘরের বাইরে দাবার ছকের মতো সাদা কালো পাথরের চওড়া বারান্ডাটা মিশেছে লাগোয়া ছাদে।পায় পায় এগিয়ে যাই।প্রশস্ত ছাদের একদিকে ভেঙ্গে পড়া পাঁচিলের ফাঁকা অংশ দিয়ে দেখা যাচ্ছে বাড়ির সদর মহলের ধ্বংস স্তুপ।আগাছার জঙ্গল।নিচে ঝুঁকে দেখি বিশাল কুয়ার ধারে হরিহর জল তোলায় ব্যাস্ত।চোখ তুলে দুরের পানে দেখি ঘন মেঘের মত সবুজ শালের জঙ্গল, জঙ্গলকে বেড় দিয়ে চষা ক্ষেতজমি। শালবন আর ক্ষেতজমির মাঝে ইতস্তত ছড়ানো এক বা দোতলা খড় বা খাপরা চালের মাটির বাড়ির শ্রেনী ।আরএক দিকে উন্মুক্ত ঢেউ খেলানো লাল মাটি বা নুড়ির উষর প্রান্তরের অসীমত্ব, ছড়ানোছিটানো আগাছার ঝোপ । সে দিকে জনবসতি নেই।

কারুর পদশব্দে পিছন ফিরি। সাধারন শাড়ী পরিহিত, সদ্য স্নাতা, পিঠে আলগোছে বাঁধা ভিজে চুলের ঢাল, আয়ত চোখে ভিরু চাহনি, ছোটখাটো নরম চেহারার একটি মেয়ে এক কাপ চা নিয়ে দাঁড়িয়ে, আন্দাজে মনে হয় বড় জোর বছর বাইশ তেইশ বছর বয়স।

কারুর পদশব্দে পিছন ফিরি। সাধারন শাড়ী পরিহিত, সদ্য স্নাতা, পিঠে আলগোছে বাঁধা ভিজে চুলের ঢাল, আয়ত চোখে ভিরু চাহনি, ছোটখাটো নরম চেহারার একটি মেয়ে এক কাপ চা নিয়ে দাঁড়িয়ে, আন্দাজে মনে হয় বড় জোর বছর বাইশ তেইশ বছর বয়স।“আপনার চা” এক ঝলকে মনে হ’ল, এই কন্ঠস্বরই তো শুনেছি কাল রাতে।তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে চা’র কাপ নিয়ে জিজ্ঞাসা করি ভবানীবাবু উঠেছেন কিনা। একটু চুপ করে থেকে বলেন ওনার উঠতে একটু দেরি হয়, সকালের খাবার আটটার মধ্যে তৈরি থাকবে ব’লে মেয়েটি অল্প হেসে একতলায় যাওয়ার সিঁড়ির দিকে ফিরে গেল।

কিছুপরে ঘরে ফিরে তৈরি হয়ে অপেক্ষার পালা।আটটা নাগাদ ঢাকা দেওয়া থালা হাতে হরিহরের আগমন।আমার প্রাতরাশ।লাগোয়া ছাদটা ভালো লেগে গেছে।খাওয়ার পরে ছাদে পায়চারীর সময় ভাবি কাগজপত্র বোঝানোর কাজ দুপুরের মধ্যে হয়ে যাওয়া উচিত, তা’হলে বিকেলের বাস ধরে বোলপুর পৌঁছে কোলকাতার ট্রেন ধরা যাবে।চিন্তার মাঝে আয়ত ভিরু দুটি মায়াময় চোখ ভেসে ওঠে।হরিহরের উপস্থিতির জানানে চিন্তায় ছেদ পড়ে। হরিহর স্বল্পবাক।তাকে অনুসরণ করে একতলায় ভবানীবাবুর পর্দা ঢাকা দরজায় হরিহরের মৃদু করাঘাত। ভেতর থেকে সম্মতি সূচক শব্দের আশ্বাসে আমারা প্রবেশ করি। বড়বড় জানলা খোলা থাকায় ঘরে আলোর প্রাচুর্য্য। ভবানীবাবু গতকাল রাতের মত, তাকিয়ায় হেলান দিয়ে আধশোয়া।দিনের আলোয় ভালো করে তাঁকে লক্ষ্য করে মনে হলো বয়ষ সত্তর কেন আশিও হতে পারে। শীর্ণ শরীর, হাজারো বলি রেখাঙ্কিত লোলচর্ম, বেহিসাবী শরীরি অত্যাচারের চিণ্হ, পুরো জীবনি শক্তি যেন পুঞ্জিভূত হয়েছে ঝুঁকে পড়া কাঁচাপাকা ঘন ভ্রুর ভেতরে দিয়ে তাকিয়ে থাকা দুটি চোখের দৃষ্টিতে। কর্কশ গম্ভীর স্বরে বলেন “উইল আর আমমোক্তার নামার খসড়া দেখেছি কিন্তু অনিবার্য কারণবশত কিছু কিছু পরিবর্তনের দরকার। তোমাকে সেইজন্য কিছুদিন এখানে থেকে আমায় সাহায্য করতে হবে। সকালে তোমার অফিসে তার পাঠিয়েছি। কাছের পোষ্টঅফিসের ফোনবুথ থেকে অফিসে ফোনে কথা বলে নিতে পারো। আমতা আমতা করে বলি আমি বেশী দিন থাকার জন্য তৈরি হয়ে আসিনি আর খসড়া পাল্টাতে গেলে অফিসের উর্ধতন সাহেবের পরামর্শ নিলে ভালো হয়। উত্তরে বলেন চিন্তার দরকার নেই। তুমিও উকিল তাই খসড়া পাল্টানো তোমাকে দিয়েই হবে। জামাকাপড়ের দরকার হলে, ব্যাবস্থা হয়ে যাবে।হরিহর কে বলেন “বল্লি” নামে কাউকে ঘরে পাঠাতে। বিভ্রান্ত অবস্থায় ভাবি কি বিড়ম্বনায় পড়লাম এই খামখেয়ালি মানুষটার পাল্লায় পড়ে। ভবানীবাবু আবার বলেন “ চিন্তা করতে আমার কয়েকটা দিন লাগবে। এর মধ্যে আমাকে অন্য কাজে একটু সাহায্য করতে হবে” টেবিলের ডাঁই করা লেখা ভরা কাগজগুলো দেখিয়ে বলেন “আমার বংশের কিছু ইতিহাস আর নিজের আত্মজীবনি লিখেছি।এই খসড়াটা তুমি যদি এরমধ্যে পাকা করে দিতে পারো।” অফিসের বড় মক্কেলের অনুরোধ,টেবিলের ওপর দিস্তা দিস্তা কাগজগুলোর দিকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নাড়ি। ভবানীবাবুর দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখি সকালে দেখা মেয়েটি কখন নি:শব্দে প্রবেশ করেছে। ভবানীবাবু স্বভাবসুলভ অমার্জিত স্বরে বলেন বল্লরী তাঁর ভাগ্নী। পাকাপাকি এখানেই থাকে। আমার থাকাকালীন যা দরকার হবে ওকে বললেই হবে।হরিহর কে টেবিলের কাগজগুলো লাইব্রেরিতে রেখে দিতে বলে, নি:শব্দ ইঙ্গিতে কথাবার্তায় দাঁড়ি টানলেন।

হরিহরের সাথে ভাঙ্গা সদর দরজার বাইরে এলে একটা সাইকেল দেখিয়ে পোষ্ট অফিসের পথ বাতলে সে বাড়ির ভেতর চলে যায়। শুনশান দিনের আলোয় চারপাশ দেখি, সদর মহলের ভগ্ন অবশিষ্ট অংশ দিয়ে দোতলার ছাদে কারুর চকিতে সরে যাওয়া নজর কাড়ে । চিন্তিত মনে পোষ্ট অফিসের দিকে রওনা হই। মেসের ম্যানেজার জগন্নাথ কে ফিরতে দেরি হবে জানিয়ে পোষ্ট কার্ড ছেড়ে, বড়সাহেবের সাথে ফোনে কথা বলে ফিরে এলাম। অপরান্হের নিঝুম জমিদার বাড়ি,পাশের বাগান থেকে ঘুঘুর ডাক ভেসে আসে। ঘরে এসে দেখি খাটের ওপর দুটো ধুতি, পিরান আর দৈনন্দিন দরকারের কিছু জিনীস যত্ন করে রাখা,সবই নতুন। টেবিলে ঢাকা খাবারের থালাও রয়েছে।

পায়ের আওয়াজে চোখ তুলে দেখি, দরজায় হাত রেখে দাঁড়িয়ে বল্লরী।

পায়ের আওয়াজে চোখ তুলে দেখি, দরজায় হাত রেখে দাঁড়িয়ে বল্লরী।উঠে দাঁড়িয়ে ওনাকে বসতে বলি।বল্লরীর কিছু কথার মধ্যে বুঝি ভবানীবাবু বেশ কিছুদিন অসুস্থতার কারনে শয্যাশায়ী। ডাক্তারের নির্দেশে তাঁর চলাফেরা, খাওয়াদাওয়া কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রিত।জানালেন হরিহরদা লাইব্রেরী ঘর পরিস্কার করে রেখেছে, দরকার অনুযায়ী ব্যবহার করতে পারি। আমার অনুরোধে একতলার লাইব্রেরী ঘরটা দেখিয়ে দিয়ে বলেন হরিহরদা বাজার গেছে, কিছু দরকার পড়লে দ্বিধা না করে জানাতে।

লাইব্রেরীর ঘরের একদিকের দেওয়াল জুড়ে একসারি আলমারি ঠাসা চামড়া বাঁধানো বই।আর একদিকের দেওয়ালে মনে হয়, ভবানীবাবুর উর্দ্ধতনপুরুষগণের কিছু তৈলচিত্র।সবুজ ফেল্টে ঢাকা মাঝারি টেবিলে ভবানীবাবুর পান্ডুলিপি।একটা টেবিল ল্যাম্পও আছে।অযত্নের ছাপ স্পষ্ট।পান্ডুলিপির দিস্তায় চোখ বোলাতে শুরু করে, লেখা দেখে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে।ভবানীবাবুর হস্তাক্ষর আর সুমেরীয় শিলালিপী পাঠোদ্ধার দুটোই প্রায় অসম্ভব।খুট শব্দে ঘরে আলো জ্বলে উঠল, অন্যমনস্ক চোখে দেখি বল্লরী, কপালে খয়েরি বিন্দি, চোখে কৌতুকের ছোঁয়া। হাসি মুখে চা এর কাপ হাতে দাঁড়িয়ে।সহজ স্বরে পান্ডুলিপির দিকে ইঙ্গিত করেন “ বেশ মুশ্কিলে পড়েছেন ?” টেবিলের সামনের চেয়ারে বসে,পান্ডুলিপীটা টেনে নিয়ে চোখ বোলাতে থেকে বলেন “একটু চেষ্টা করে দেখব? মামাবাবুকে বলবেন না কিন্তু।” সন্দেহাচ্ছন্ন স্বরে বলি অবশ্যই “বাংলায় গ্র্যাজুয়েশনের পর মা মারা যাওয়ায় আর পড়া হয়নি।” ডোবার আগে হাতের নাগালে খড়কুটো দেখতে পেলাম।বলে উঠি নিশ্চয় নিশ্চয়, বাঁচালেন আমাকে।পান্ডুলিপির প্রথম পাতা সামনে রেখে, সাদা পাতা নিয়ে লিখতে শুরু করেন। অবাক চোখে তাকিয়ে থাকি বল্লরীর সুগোল হাতের মুক্তাক্ষরের দিকে।কিছুক্ষন পরে “ মামার আর আপনার রাতের খাওয়ার ব্যাবস্থা করে আসি।” পুরানো গন্ধময় ঘরটা নিস্প্রভ হয়ে যায়।পান্ডুলিপির প্রথমপাতা আর মুক্তাক্ষরে লেখা পাতা পাশাপাশি রেখে মনে হ’ল বা: বিষয়বস্তু বেশ পরিস্কার লাগছে তো! মনটা শ্রদ্ধামিশ্রিত স্নিগ্ধতায় ভরে যায়।

শীতের দিনগুলি বয়ে যায়, সকালে বল্লরীর চা’র কাপ হাতে ছাদে আসা, দুপুরে সন্ধ্যায় পান্ডুলিপির পাঠোদ্ধারের অনুশীলনে মনোনিবেশ, নিয়ম হয়ে দাঁড়ায়।পান্ডুলিপি নাড়াচাড়ার ফাঁকেফাঁকে নানা কথার মাঝে বল্লরীর কাছে শুনি তাদের ইতিহাস।কট্টর ভবানীবাবু মানতে পারেননি তাঁর বোনের অসমবিবাহ এক সাধারন স্কুলশিক্ষকের সাথে।সমস্ত সম্পর্ক ত্যাগ করেছিলেন বোনের মৃত্যুর দিন অবধি। ছয় মাস হলো পিতৃমাতৃহীন ভাগ্নীর অসহায়তার খবর পেয়ে বল্লরীকে নিয়ে এসেছেন, সম্ভবত তাঁর নিজের স্বার্থও জড়িত ছিল। 

বিজনপুরীতে দুজন একা মানুষ, যাদের একাকিত্ব পরস্পরকে নিকট করেছে। একজনের কর্মজীবনের অনিশ্চয়তা আর একজনের চোখ ভবিষ্যত অসহায়তার অকুলপাথারে অবলম্বনের খড়কুটো খোঁজে। ভোরের ঘন মেঘমেদুর শালবনের  সবুজের আভাস নতুনত্বের স্বাদ বয়ে আনে। পশ্চিমের আদিগন্ত লাল উষর মাটি ছুঁয়ে আসা দিনান্তের অস্তগামী সূর্যর গৈরিক আভায় বল্লরীর আরক্তিম মুখে নতুনের খোঁজ পাই। বেশ কয়েকটা দিন পেরিয়ে যায়।

এক সকালে ভবানীবাবুর ডাক আসে। সমাপ্ত হওয়া পান্ডুলিপির গোছা তাঁর হাতে তুলে দিলাম।প্রথম দু একা পাতা পড়ার পর ওনার সদা কুঞ্চিত মুখে এক নতুন ভাবের সঞ্চরন, যাকে খুশির ছোঁয়া বলা যায়। “ এটাই চেয়েছিলাম” কথায় যেন সন্তুষ্টির ভাব।সাহস করে জানালাম পুরোটাই বল্লরী করেছে।ক্ষনিকের তরে অবাক হয়ে, নরম স্বরে আমাকে বসার নির্দেশ দিয়ে বলেন “উইলের ব্যাপারটা ঠিক করতে আরো কিছুদিন লাগবে।” বিছানার পাশে মোটা একটা খাতা আমার হাতে দিয়ে বলেন “ গতকাল তোমাদের অফিস থেকে আসা টেলিগ্রাম থেকে বুঝলাম উইলের ব্যাপারটা যতদিন না মেটে, আমার কিছু জমে থাকা দরকারি কাজের ভার তোমায় হাতে তুলে দিতে।এই খাতাটা পড়লেই বুঝতে পারবে।” কথায় ক্লান্তির ছায়া অনুভব করে, লাইব্রেরীতে খাতাটা নিয়ে বসি।

চাকরিটা আর থাকবে কি না সন্দেহ জাগে।মনের মধ্যে হতাশার সঙ্গে উৎফুল্লতার সংমিশ্রনের ভাব কেন, বুঝে ওঠার চেষ্টা করি।

চাকরিটা আর থাকবে কি না সন্দেহ জাগে।মনের মধ্যে হতাশার সঙ্গে উৎফুল্লতার সংমিশ্রনের ভাব কেন, বুঝে ওঠার চেষ্টা করি।

দুপুরে বসে খাতার পাতা উল্টোই। বেশ কিছু জমি আর বাড়ির বিবরণ, অনেকগুলির পাশে পাশে জিজ্ঞাসা চিন্হ। পরের দিন ভবানীবাবুর সাথে আলোচনা করে বুঝি- বহুদিন শয্যাগত থাকায় কিছুই দেখাশোনা করা হয়নি।আমাকে বাঁধা জট ছাড়াতে হবে। বল্লরীর সঙ্গে পরামর্শ করে লেগে পড়লুম।

অফিসের দিক থেকে উচ্চবাচ্চার অভাবে তাদের কাছে আমার অপ্রয়োজনিয়তা এখন প্রতিষ্ঠিত।সঞ্জীবিত বল্লরীর বাড়িময় চঞ্চল চলাফেরা, হরিহরের সদা কৃত্রিম হাস্যমুখে আসল হাসির রেশ দেখি।

অনেকগুলো মাস পেরিয়ে গেছে।বেশ কয়েকটা ব্যাপারের জট কাটানো গেছে। ভবানীবাবুর কুঞ্চিত মুখে সদা প্রসন্নতা লক্ষ্য করে সবাই।কর্কশতা প্রায় উধাও। অফিসের দিক থেকে উচ্চবাচ্চার অভাবে তাদের কাছে আমার অপ্রয়োজনিয়তা এখন প্রতিষ্ঠিত।সঞ্জীবিত বল্লরীর বাড়িময় চঞ্চল চলাফেরা, হরিহরের সদা কৃত্রিম হাস্যমুখে আসল হাসির রেশ দেখি।

এবার এক বিকেলে ডাক পড়ে ভবানীবাবুর ঘরে। দেখি বল্লরী বসে তাঁর পাশে।বহুবার একত্র আলোচনায় আড়ষ্ট পরিবেশ উধাও। উইলের খসড়াটা এগিয়ে দিয়ে নির্দেশ দিলেন, তাঁর কোলকাতার বাড়ির একতলায় আমায় অফিস করে ওনার এষ্টেট পরিচালনা ও অন্যান্য কাজের সাথে ওকালতি শুরু করতে হবে। যত শীঘ্র সম্ভব অফিস চালু করা চাই।বল্লরী দিকে স্বস্নেহ চাহনিতে বলেন সময় বড় কম।সংশোধিত উইলে দেখি আগের দুজন ওয়ারিশের নাম পেনশিল দিয়ে কেটে বল্লরীর নাম আর মোক্তারনামায় আমার অফিসের নামের পরিবর্তে প্রনয় সেন নামটা লেখা রয়েছে।

এক সন্ধ্যার পর,ভাঙ্গা ছাদের একপ্রান্তে দুজনেই লক্ষ্য করি দুর আকাশ কোণে উল্কা বৃষ্টির খেলা, অজান্তে বলে ফেলি বল্লরী আমায় বিয়ে করবে?

প্রায় ছয় মাস কেটে গেছে কোলকাতার অফিসে আর মাঝেমাঝেই উদ্ধরনপুরে যাতায়াত করে।অনুভব করি কবে থেকে যেন বল্লরী আর প্রনয় সেন পরস্পরের পরিপূরক হয়ে উঠেছে।এক সন্ধ্যার পর,ভাঙ্গা ছাদের একপ্রান্তে দুজনেই লক্ষ্য করি দুর আকাশ কোণে উল্কা বৃষ্টির খেলা, অজান্তে বলে ফেলি বল্লরী আমায় বিয়ে করবে? বলেই চরম অস্বস্তিতে পড়ি,দুরে পালিয়ে যেতে মন চায়।সহসা অনুভব করি বল্লরীর থর থর কাঁপা হাত আমার হাতের মুঠোয়। অন্ধকার আকাশের নিচে পরস্পরের পানে চেয়ে কতক্ষন দাঁড়িয়েছিলাম জানা নেই। ভূলোক দ্যুলোক এক হয়ে গেল বল্লরীর হাতের মৃদু চাপে।

পরের দিনই ভবানীবাবুর ঘরে দুজনে গিয়ে দাঁড়াই। প্রবল অস্বস্তি হয় বল্লরীর বাবা মার পরিনতির কথা মনে করে। মনে জোর এনে ভবানীবাবুকে বলেই দিলাম দুজনের মনের কথা। ভবানীবাবু নিশ্চুপ, অগ্নুৎপাতের আশঙ্কায় দুরুদুরু মনে দাঁড়িয়ে থাকি, সময় থেমে যায়। অনেকক্ষন পর, ভবানীবাবু খাট থেকে উঠতে গিয়ে একদিকে হেলে পড়েন। দুজনে দ্রুত এগিয়ে ওনাকে সামলাবার চেষ্টা করার সময় দু’হাতে আমাদের জড়িয়ে ধরেন, দেখি তাঁর কুঞ্চিত মুখে প্রশান্তির অনাবিল হাসি, চোখের কোনে জল।

মনে হল আমরা তিন জনই বাঁচার তাগিদে একে অপরের ভেতর অবলম্বনের সন্ধান পেয়ে গেছি।

-Advertisement-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here