-Advertisement-

কাঠ গোলাপ

“দ্যাখ মাস্টার, কেবল গপ্পে হয় না – টাটকা গরম হাতেনাতে যদি কিছু দেখাতে পারো’তো বলো।” সমর ডাক্তার ঝাঁঝিয়ে ওঠেন।

মনস্তত্ত্বের অধ্যাপক অপরেশ বাবু তাঁর কালো মোটা ফ্রেমের বাইফোকাল চশমার কাঁচ মুছতে মুছতে বলে ওঠেন –

“ডাক্তার ! আগেও বলেছি, ওই শারীরিতত্ত্ব নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে তোমার সুক্ষ্ম বোধটা দড়কচা মেরে গেছে। প্রেত তত্ত্ব ব্যাপারটা – তোমার ওই মস্তিস্কে গজাল  মেরে না প্রবেশ করালে বোঝানো যাবে না।”

যথারীতি তর্ক বিতর্ক বেশ জমে উঠেছিল সেদিন সন্ধ্যে বেলায়।

শহরের প্রথিতযশা অভিজ্ঞ আইনজীবী বীরেন্দ্র রায়ের দক্ষিণ কোলকাতার সাবেকি আমলের বাড়ি। সদর দরজার ঠিক পাশ ঘেঁসে বহু পুরনো একটি বোগেনভেলিয়া গাছ বাড়ির দেওয়াল ধরে তিনতলার ছাত ছুঁয়েছে।  ফুলের সময় মনে হয় থাকে থাকে ঘন রক্তাভ মেঘ যেন বাড়ির ছাত  থেকে দেওয়াল ছুঁয়ে বেশ কিছুটা নেমে এসে স্থির হয়ে  গেছে।  এক তলার চেম্বারের পাশের লাইব্রেরী ঘরে প্রতি শনিবার সন্ধ্যেবেলা অল্প কিছু বন্ধুর সমাগম হয়। আর কেউ আসুক না আসুক- সমর বাবু পেশায় ডাক্তার,বীরেন্দ্রবাবুর সমবয়সী, কয়েক মাস হল সরকারি চাকরি ছেড়ে এখন ব্যক্তিগত পসার বাড়াতে উদ্যোগী। অপরেশ বাবু অধ্যাপক, কোলকাতার বিখ্যাত কলেজে মনস্তত্ব বিভাগের প্রধান আর কৈলাশ, অল্প বয়স –  চিত্রশিল্পী। কয়েক বছর আগে আর্ট কলেজ থেকে পাশ করেছেন। ইদানীং তাঁর আঁকা ছবি বিভিন্ন শিল্প প্রদর্শনীতে প্রশংসিত হয়েছে। সুতরাং তাঁকে দেশের একজন উদীয়মান চিত্রশিল্পী বলা যেতে পারে। এঁরা তিন জন কখনই গরহাজির থাকেন না। শীত বর্ষা তাচ্ছিল্য করে বীরেন্দ্র বাবুর বাড়িতে ওই দিন গুলোতে সাধারণত: হাজিরা দেন।

এই চার জনের বয়সের ফারাক বা পেশার বিভিন্নতা থাকলেও তাঁরা জগতের একটি বিষয়ে মোটামুটি এক শিবিরে। প্রেত তত্ত্ব  বিষয়ে কৌতূহল বা মৃতের আত্মার সাথে বার্তালাপ সম্ভব কি সম্ভব নয় এই বিতর্কে সময় কাটানো। সমর বাবু ছাড়া সবাই এই বিষয়ে অল্প বিস্তর পড়াশোনা করেন। কেবল সমর বাবু চাক্ষুষ সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে বিশ্বাস অবিশ্বাসের মাঝে দোদুল্যমান। বীরেন্দ্রবাবু তাঁর তীক্ষ্ণ বাক্য জালে বাঘা বাঘা জজ সাহেবদের কব্জা করতে পারেন কিন্তু সমর বাবু কে কাবু করতে তিনিও অপারগ। তবে আপাতত: আগের কোনো শনিবারে বীরেন রায়ের নিজস্ব অভিজ্ঞতা ‘চাঁদনী’র কাহিনীটা ( **) শুনে তিনি যেন একটু দলের দিকে হেলে পড়েছেন, তা’হলেও তর্ক করতে ছাড়েন না।

সাধারণত: প্রেত তত্ত্ব বা রহস্যময় কাহিনীর আবহ মন্ডল হয়ে থাকে বর্ষার বা শীতের রাত। পরিবেশটা সচরাচর হওয়া উচিত -হঠাৎ বিদ্যুত বিভ্রাটে, গলদশ্রু মোমবাতির কাঁপা নরম আলো আবদ্ধ হয়ে থাকবে নিজস্ব ছোট বৃত্তে, অন্ধকার দানা বাঁধবে বড় ঘরের কোনায় কোনায়। বাইরে অবিশ্রান্ত বৃষ্টি অথবা কনকনে শীতের রাত। তা’হলেই ভুতুড়ে বা রহস্য কাহিনী আকর্ষক হয়ে ওঠে।

কিন্তু সেদিন সন্ধ্যে বেলা বীরেন রায়ের লাইব্রেরীতে না বসে, মনোরম ঝিরঝিরে বাতাস উপভোগের জন্য, সবাই বসেছিলেন বাড়ির পিছনের লনের ওপর কিছুটা ছড়ানো অর্ধচন্দ্রাকৃত পুরনো আমলের লাল মেজের  বারান্দায় ছড়িয়ে রাখা সাদা বেতের সোফায়।বারান্দার আলোর হলুদ রেশ কিছুটা ছড়িয়ে পড়েছিল ছোট সবুজ লনের ওপর। বাড়ির সীমানার পাঁচিল ছুঁয়ে দুটো বড় কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়ার কিছু লাল আর হলুদ ফুল ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল লনের সবুজে, পাশের বাড়ির ঝাঁকড়া বাদাম গাছটা এই লনের দিকে একটু ঝুঁকে দাঁড়িয়ে ছিল নিঃশব্দে। ভুতুড়ে গল্পের পরিবেশ ছিল বলা যায় না।

বীরেন রায়ের খাস কাজের লোক হারু নিঃশব্দ পা’এ সবার সামনে রেখে গেছিল কফির কাপ। কৈলাসের চারমিনারের কটু ধোঁয়ায় মিশে যাচ্ছিল বীরেন্দ্রবাবুর প্রিয় Asthon সিগারের সুবাস।

“বীরেন তোমার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে বেশ কড়া জাতের যদি কিছু থাকে’তো বার কর দেখি, এই ডাক্তারকে নিয়ে আর পারা গেল না।” অপরেশ বাবুর গলায় হতাশা জেগে ওঠে।

বীরে বাবুর অলস চোখ স্থির হয়ে আছে লনের দিকে। ঝিরঝিরে হাওয়ায় কৃষ্ণ-রাধাচূড়া মাথা দোলায়। কোথা থেকে কিছু রাত পোকা এসে জমতে শুরু করেছে বারান্দার ঝোলানো আলোর চারপাশে। প্রায় নিস্তব্ধ চারিদিক –বীরেনের বাড়ি থেকে প্রায় এক-শো মিটার দূরের ব্যস্ত বড় রাস্তার গাড়ি বাসের হর্নের ক্ষীণ আওয়াজ মাঝে মাঝে ভেসে আসে।

বীরে বাবু সিগারে মৃদু টান দিয়ে বলেন-

“ঠিক আছে – আমার আর একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি”- এবার সমর ডাক্তারে দিকে ফিরে বলেন –“তবে  রহস্যটা অতি প্রাকৃতিক  কি না, তার বিচার তোমাদেরই করতে হবে। তা’হলে চলো লাইব্রেরীতে বসা যাক, রাত পোকা গুলোর দৌরাত্ম বেড়ে যাচ্ছে।”

হারু’কে আর এক প্রস্থ কফি আনতে বলে, লাইব্রেরীতে গিয়ে বসা হলো। এয়ার কন্ডিশনারের ঠান্ডার আমেজের সাথে রুম ফ্রেশনারের সুগন্ধি। সবুজ ঢাকনায় স্ট্যান্ড ল্যাম্পের নরম আলো পুরোটা ছড়াতে পারেনি বিশাল ঘরের চার কোনায়।  বাকি তিন জন উৎসুক চোখে তাকিয়ে থাকে বীরেন বাবুর দিকে।

তিনি ধীরে সুস্থে আরম্ভ করেন –

“ তোমরা জানো বেশ কিছুদিন কাজের ব্যাপারে আমি ছুঁৎমার্গে ভুগছি। যদি সত্যি কোনো ইন্টারেষ্টিং কেস পাই, তা’হলেই যুক্ত হই, নচেৎ সে কাজ নিই না। সেবার একটি কাজ এসেছিল আমার এক বন্ধু সলিসিটরের থেকে,এড়াতে পারিনি। খুব সামান্য ব্যাপার – একটা উইল বাতিল করে নতুন আর একটি করা হবে আর ক্লায়েন্ট চাইছিল আমার পরামর্শ কিন্তু চাক্ষুষ করলাম একটা  রহস্যময় ঘটনা। ঘটনাটা বলব আমি যা দেখেছি কিন্তু চরিত্রগুলি কল্পিত নামে উল্লেখ করব। তারপর তোমরা যা বুঝবে।”

বীরেন্দ্রবাবু   সিগার এ্যাসট্রেতে রেখে শুরু করলেন –

“ ক্লায়েন্ট ভদ্রলোক বেশ ধনী, বয়স আশির কাছে কিন্তু সন্দেহ প্রবণ, খিটখিটে। তাঁর ওপর অর্থনৈতিক ভাবে বাড়ির সবাই নির্ভরশীল। তাঁর সব কিছুই সুষ্ঠু ভাবে করে দিয়াছিলাম কিন্তু মাস দুয়েক পর ঘটনা প্রবাহ আচমকাই বাঁক নিল এক নতুন পথে।”

বেশ কিছুক্ষণ কিছু ভেবে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে আবার আরম্ভ করলেন –

“ সেদিন ছিল বুধবার, সান্ধ্য পানীয় নিয়ে বসেছিলাম লনের বারান্দায়। হারু এসে বলে একটি মেয়ে এসেছে দেখা করতে। একটু আশ্চর্য হয়েছিলাম। হারু যখন বলছে ‘একটি মেয়ে এসেছে’ তার মানে আমার পরিচিত কেউ নয়। প্রথমে ভেবে ছিলাম বলে দিতে বলবো এখন দেখা হবে না কিন্তু জিজ্ঞাসা করাতে হারু বলে মেয়েটি নাম বলেনি তবে বয়স বেশী নয় আর তার ধারণায় ভদ্র ঘরের মেয়ে। কৌতূহলী হয়ে বলেছিলাম চেম্বারে বসাতে।”

একটু থেমে বললেন –“ এবার যা বলবো, কিছুটা ব্যক্তিগত, তবে কাহিনীর বিষয়বস্তু সঙ্গে জড়িত বলতে পার।” এবার একগাল সিগারের ধোঁয়া ছড়িয়ে গল্পের রেশ ধরেন–

“ মিনিট পাঁচেক পর চেম্বারে এসে হোঁচট খেলাম। রুচিসম্মত সালোয়ার কামিজ পরিহিত, এক ঢাল রেশমী চুলের বিনুনী, মনে হয় বেশ লম্বা, আমার টেবিলের সামনের চেয়ারে মেয়েটি বসে আছে দরজার দিকে পিছন ফিরে।বসার ভঙ্গিটা যেন বেশ পরিচিত। টেবিলের অপর দিকে নিজের চেয়ারে বসে হতবুদ্ধি হয়ে নিজের অজান্তে একটা শব্দ বেরিয়ে এসেছিল” –

‘সঙ্গীতা ???’

 ‘না, আমার মা’র নাম সঙ্গীতা। আমি মল্লিকা চৌধুরী।’

“ কয়েকটা মিনিট সিনেমার রিলের মত চোখের সামনে দৃশ্যপট সরে সরে গেল। দীর্ঘ দিন আগে, বলতে পার তেত্রিশ বছর তো বটেই, কিছু বেশীও হতে পারে। আমি সবে আইন পাশ করার পর অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে যাওয়ার মাস ছয়েক আগে, হঠাৎ আলাপ হয়ে গেছিল সঙ্গীতার সঙ্গে। কথা ছিল ফিরে এসে ওর খুব কড়া প্রকৃতির বাবার সঙ্গে দেখা করব কিন্তু লন্ডন পৌঁছনোর এক মাস পর পেয়েছিলাম সঙ্গীতার বিয়ের খবর। আমাদের দু’জনেরই কিছু করার ছিল না। যোগাযোগও এরপর  ছিন্ন হয়ে যায় স্বাভাবিক কারণে।”

‘আমি একটু বিপদে পড়ে এসেছি। জানি আপনি আমাকে সাহায্য করবেন।’ মেয়েটি সরল ভাবে বলে।

‘তুমি আমার কাছে এসে খুব ভালো করেছ কিন্তু যদি তোমার আইনি পরামর্শ দরকার হয়, আমার জানাশোনা ভালো ল’ইয়ার ঠিক করে দিতে পারি। আসলে এখন কাজ কর্ম আমি খুব বিশেষ করি না।’

“বুঝতেই পারছ, আসলে আমি এড়িয়ে যেতে চাইছিলাম। কিন্তু মল্লিকা সরল স্বরে  আবার বেশ দৃঢ়তার আভাস —”

‘ না: অন্য কাউকে দিয়ে হবে না। আপনাকেই সাহায্য করতে হবে।‘

“বেশ দাবির সুরে সে বলেছিল কথা গুলি। আমি একটু হতভম্ব হয়ে গেছিলাম, আবার মেয়েটি সরল বিশ্বাসে আমার ওপরে দাবি জানাতে, মজাও পেয়েছিলাম।“

‘এবার আমার আর কয়েকটা কথা শুনতে হবে। বাবা মারা যান আমার চোদ্দ বছর বয়সে। মা তখন খুবই অসুস্থ। ক্যান্সার ধরা পড়েছিল। সেই সময় আমরা দাদুর বাড়িতে চলে আসি। দাদুর ইচ্ছায় আমার পড়াশোনা সব হষ্টেলে থেকে হয়েছিল। মা’র সাথে যোগাযোগ ছিল চিঠি পত্রে। কেবল স্কুল কলেজের লম্বা ছুটির সময় দাদুর বাড়িতে আসতাম। কিছু বছর আগে মা’ও মারা গেলেন।’

‘সঙ্গীতা মারা গেছে !!!’

‘হ্যাঁ – গ্র্যাজুয়েশনের পর দাদু আমাকে নিয়ে আসেন তাঁর বাড়িতে। তখন আমার একুশ বাইশ বছর বয়স। তিনি ভয়ানক পুরনো পন্থী আবার খুব কড়া ধাতের মানুষ। পড়াশোনা বন্ধ করে দিয়ে সেই সময় থেকে আমার বিয়ের চেষ্টা করছেন। কিন্তু আমার  নিজের পা’য়ে দাঁড়ানোর ইচ্ছে। এই নিয়ে খিটিমিটি লেগেই রয়েছে‍। বাড়িতে কিছু করার ছিল না। মাঝে মাঝেই মা’র আলমারিতে তাঁর ব্যবহৃত জিনিসপত্র নিয়ে নাড়াচাড়া করি সময় কাটানোর জন্যে, আবার ভালোও লাগে। হষ্টেলে থাকার সময় মা’কে লেখা আমার চিঠিগুলি যত্ন করে রাখা , তা’ছাড়াও আরো অনেক খুঁটিনাটি জিনিস ছিল আলমারিটাতে। বলতে পারেন ওই আলমারির কাগজপত্র যা ছিল বা অন্যান্য জিনিসগুলো প্রতিটি আমার চেনা। মাস কয়েক আগে, আলমারিটা ঘাঁটার সময় একটা আশ্চর্য ব্যাপার হলো একদিন। পুরানো চিঠিগুলোয় চোখ বোলাচ্ছি, হঠাৎ একটা ছোট ভাঁজ করা কাগজ সেই চিঠি গুলির থেকে  মেজেতে পড়ল। অবাক হয়ে ভাবলাম এই আলমারির প্রতিটি জিনিস, প্রতিটি কাগজ আমি চিনি কিন্তু ওই ভাঁজ করা কাগজটা কখনো দেখিনি। এখনো ভাবি  কাগজটা এলো কোথা থেকে ???  কাগজটা খুলে দেখি, আমাকে লেখা মা’র একটা চিঠি।  দেখে মনে হল চিঠিটা শেষ করা হয় নি আর ওটাই ছিল বোধ হয় আমাকে লেখা মা’র শেষ চিঠি।’

“আমি আশ্চর্য হয়ে মেয়েটির জীবন কাহিনী শুনছিলাম। সঙ্গীতা মারা গেছে শুনে মনটা ভীষণ খালি খালি লাগছিল। হঠাৎ মেয়েটির কথায় হুঁশ ফেরে। দেখি একটি ভাঁজ করা হলদেটে হয়ে যাওয়া চিঠির কাগজ আমার দিকে এগিয়ে দিয়েছে।”

‘ এইটাই দু’এক মাস আগে চিঠি পত্র ঘাঁটাঘাঁটি করার সময়  হঠাৎই অন্যান্য চিঠি পত্রর থেকে মেজেতে পড়েছিল।’

“হত বুদ্ধি হয়ে কাগজটা নিয়ে সাবধানে খুলি। একটা অর্ধ সমাপ্ত চিঠি। ওপরে মল্লিকা নামটা লেখা। কোনো তারিখ নেই। হাতের লেখা এতদিন পরেও পরিচিতির আভাস নিয়ে এসেছে। মেয়েকে লেখা মা’র অল্প কয়েকটা কথার পর –

 যদি বিপদে পড়িস কোনো দ্বিধা না করে (এরপর আমার নাম ঠিকানা লেখা) সঙ্গে অবশ্যি দেখা করবি। দেখবি উনি সব ঠিক করে দেবেন।

এরপরই চিঠিটা মাঝখানেই শেষ হয়ে গেছে, কোনো কারণে শেষ না হওয়ায় মেয়েকে আর পাঠানো হয় নি। মল্লিকা তখন সরল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। বোধ হয় মনে মনে বলছে-

 আর – না বলবে ?’

বুঝলাম মেয়েটি দাবি করার জোর কোথা থেকে পেল! বসার ঘরের ঘড়ি রাত ন’টা বাজার জানান দিল।

নিজেকে একটু ধাতস্থ করে, মল্লিকাকে বলি আমি তার সঙ্গেই আছি এবং থাকব। যখনই দরকার মনে হবে, দ্বিধা না করে আমার সঙ্গে সে যোগাযোগ করতে পারে। এবার তার ঠোঁটের কোনায়  যেন জয়ীর হাসি দেখা দিল। মনে হয় ভাবছে চিঠির ওই কথাগুলো এড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। মেয়েটি একবার হাতের ঘড়িটা দেখে একটু তাড়াহুড়ো করে বলতে আরম্ভ করে।” –

‘আমাদের বাড়িতে দাদু – নিশানাথ সিংহ, মামা প্রশান্ত, মামিমা জয়শ্রী আর আমি থাকি, আর আছে দাদুর বহু দিনের কাজের লোক প্রহ্লাদ দা। মাঝে মাঝেই মামা মামিমার সঙ্গে দাদুর ঝগড়া লেগেই থাকে। বাড়িটার পরিবেশ বলতে পারেন অসহ্য হয়ে উঠেছে। আমি সেই জন্য চাকরি খুঁজচ্ছি – পেলেই ওই বাড়ি থেকে চলে যাব। তবে এখন আমায় উঠতে হবে কারণ রাত ন’টার পর ফিরলে দাদু বাড়ি মাথায় তোলেন।  আমাকে এখন যেতে হবে আর আপনার সময় অনুযায়ী আপনার কাছে আবার আসতে পারি? আমার আরো কিছু জানার আছে।’

“খুব সহজ সরল দাবি। রাজি হয়ে পরের দিন সন্ধ্যে ছ’টায় চলে আসতে বলি, মল্লিকা চাইতে আমার একটা ভিজিটিং কার্ড দিয়ে দিলাম। মেয়েটির  সঙ্গে সদর দরজা অবধি এলাম। মনে হল সঙ্গীতা যেন চলে গেল।

“অন্যমনস্ক হয়ে ভাবি —

 ‘আরে! এই –নিশানাথ সিংহের দ্বিতীয় উইলটা তো আমিই করেছি! মল্লিকাকে কথাটা আর বলা হয়ে ওঠেনি।”

এদিকে  বসার ঘরের গ্র্যান্ড ফাদার ঘড়ির গম গমে আওয়াজ জানান দিল রাত দশটা বাজার। সে দিন সবাই সহমত হয়ে ঠিক হল গল্পের বাকিটা শোনা হবে পরের শনিবার।

 সবাই চলে যাবার পর বীরেনবাবু একা বসে থাকেন লাইব্রেরীর আলো আঁধারে। তাঁর মনে ফিরে গেছে তাঁর বিদেশ যাওয়ার কয়েক দিন আগের সেই উত্তাল বর্ষা মুখর সন্ধ্যায়। বন্ধুর নির্জন  ফ্ল্যাটে বসেছিলেন সঙ্গীতার সঙ্গে।–বাইরের ঝড় বৃষ্টিতে উদ্দাম পুরুষ আকাশ ও পিপাসিতা ধরিত্রী হঠাৎই বাধা বন্ধ চুরমার করে  পরস্পরের  অমোঘ আকর্ষণে বদ্ধ ঘরের ভেতর চলে এসেছিল পরস্পরের কাছাকাছি, ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল দুটি তরুণ হৃদয় ও শরীর। দুজনের অবচেতন যেন জানান দিচ্ছিল এই ক্ষণেকের তরে এক  হয়ে যাওয়াই ছিল বোধ হয় তাঁদের শেষ দেখা হওয়ার ভবিতব্যের ইঙ্গিত।  এরপর আর দেখা হয়নি সঙ্গীতার সঙ্গে। মল্লিকার প্রতি অদ্ভুত এক টান যেন অনুভব করেন । বড়ই কাছের মনে হয় মেয়েটিকে। কয়েকবার মাথা ঝাঁকিয়ে নিজেকে ফিরে পেয়ে উঠে পড়েন তিনি।

পরের শনিবার সন্ধ্যাবেলা যথারীতি একে একে তিন বন্ধু বীরেনবাবুর বাড়ি এসে গেলেন।  সেদিন লাইব্রেরীতেই বসা হল। একটু পরেই হারু  এক প্লেট বেগুনি, আলুর চপ আর অপরেশ বাবুর জন্য এক প্লেট ডাইজেস্টিভ বিস্কুট নিয়ে এসে হাজির। বীরেনবাবু একটু পরেই ঘরে এসে স্ট্যান্ড ল্যাম্পের নিচে তাঁর প্রিয় চেয়ারে বসলেন। অন্যান্য কিছু কথার পর, সমর বাবু বলে উঠলেন –

“বীরেন, এবার সেদিনের গল্পের বাকিটা আরম্ভ হোক।”

বীরেনবাবু একটা বেগুনিতে কামড় দিয়ে বললেন –

“ ঠিক – সেদিন বলেছিলাম মল্লিকা পরের দিন সন্ধ্যেবেলা আমার বাড়ি আসবে বলে চলে গেল, তখন রাত প্রায় ন’টা।”

এর মধ্যে হারু কফির ট্রে সেন্টার টেবিলে রেখে নিঃশব্দে চলে যায়। সবাই কফির কাপ তুলে নিয়ে বীরেনবাবুর দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

“সে রাতে বুঝলে ঘুমটা বড় ছাড়া ছাড়া হল। সমানে সঙ্গীতার ঝাপসা হয়ে যাওয়া চোখ দুটো ভেসে উঠছিল। কোলকাতা ছেড়ে চলে যাওয়ার কয়েক দিন আগের সন্ধ্যায় দেখা তার কাতর চোখ দুটো ঘুমের মধ্যে জীবন্ত হয়ে উঠেছিল। সমর নিশ্চয়ই হাসবে শুনে- তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় অনুভব করছিলাম চোখ দুটো কিছু যেন বলতে চাইছে।

এখন যেন মনে হয় সঙ্গীতা সেদিন বুঝেছিল সেই সন্ধ্যেতেই হল আমাদের শেষ দেখা। একদিন বলেছিল তার বাবা খুবই কড়া প্রকৃতির আর কট্টর পুরনো পন্থী মানুষ। আমি সেই সময় বুঝতে পারিনি তিনি নিজের পরিবারের মানুষদের ব্যক্তিগত মতামতের একেবারেই তোয়াক্কা করেন না।

সঙ্গীতা তার বাবার কঠোর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে স্নায়ু যুদ্ধে বোধ হয় পেরে ওঠেনি। ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে বাড়ির পছন্দ করা মানুষকে মেনে নিতে হয়েছিল। কিন্তু মেয়েকে লেখা ওই অসমাপ্ত চিঠির কথাগুলো মনে হয় প্রমাণ করে দিয়েছিল আমার প্রতি তার নিখাদ বিশ্বাস – অবস্থাজনিত কারণে তার দরকারের সময় হাজির থাকতে না পারলেও – সে যেন বুঝিয়ে দিতে চাইছে তার প্রত্যাশা – – আমি তার মেয়ের বিপদের সময় সাহায্য করতে পারব। কিন্তু কি বিপদ তখনও বুঝতে পারিনি।”

একটু থেমে কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলতে আরম্ভ করেন  –

“আগে বলেছি সে রাতটায় ভালো ঘুম হয় নি। বোধ হয় অবচেতনের কোনো তাড়নায় উঠে পড়েছিলাম ভোর রাতে,তখন ভোর চারটে।  ঠিক ওই সময় শোওয়ার ঘরের ফোনটা ক্রমাগত বেজে চলেছিল। সাধারণত অত সকালের ফোন আমি উপেক্ষা করে থাকি কিন্তু কেউ যেন আমাকে ঠেলে পাঠিয়ে দিল বেজে চলা ফোনের দিকে। অপর প্রান্তে শুনি মল্লিকার ভেঙ্গে পড়া গলার স্বর –

‘আপনি একবার এখনই আমাদের বাড়ি আসবেন ? দাদু হঠাৎ কাল রাত আড়াইটে নাগাদ হার্ট এ্যাটাকে মারা গেছেন। মামাও কেমন যেন অদ্ভুত আচরণ করছে, কি করব বুঝতে পারছি না –’

“সারা রাত না ঘুমানোর আড়ষ্টতা কেটে গিয়ে হঠাৎ যেন সজাগ হয়ে উঠি। মল্লিকার প্রতি একটা  টানের অনুভব আবার প্রকট হয়ে ওঠে। ওদের বাড়ির রাস্তাটা মনে আছে, তাও মল্লিকার থেকে ওদের ঠিকানাটা জেনে নিয়ে, তৎক্ষনাৎ তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ে ছিলাম। ওদের বাড়ি আমার এই বাড়ির কাছেই, বড় জোর  পনেরো মিনিটের হাঁটা পথ।

রাস্তা প্রায় শুন শান, মেঘলা আকাশ। জোর কদমে হেঁটে গিয়ে দেখি বাড়ির সামনের ফুটপাথে মল্লিকা দাঁড়িয়ে রয়েছে। এই বাড়িটার ভিতরে যাওয়ার সুযোগ আগে হয় নি। বাড়িটা কোমর সমান পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। সামনে দু পাল্লার কাঠের গেট দিয়ে ঢুকে বেশ খানিকটা উসকোখুসকো ঘাসের চত্বর, সেই চত্বর পেরিয়ে দোতলা পুরনো আমলের বাড়ি। আগের মেরুন রং জলে রোদে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। দোতলার দু’দিকে লাল টালিতে ছাওয়া  সাদা রেলিঙে ঘেরা ছোট ঝুল বারান্দা। বাড়িটার পূব পশ্চিমে দুটো পেল্লায় ফ্ল্যাট বাড়ি, এই বাড়িটাকে যেন কোন ঠাসা করে রেখেছে। বাড়ির সদর দরজায় যেতে যেতে দেখলাম খোলা চত্বরের ভেতর দুটো বড় বড় আম গাছ, একটা নারকেল আর ফুলে লাল হয়ে থাকা একটি কৃষ্ণ চুড়া। গাছগুলির ডালপালা বাড়িটার ওপর ছড়িয়ে পড়ে যেন আব্রু রক্ষা করছে। বাড়ির ফ্যাকাশে মেরুন দেওয়াল ঘেঁসে  সবুজ পাতার মাঝে সাদা পাপড়ির গায় গোলাপী পরশ গুচ্ছ গুচ্ছ  ফুলে ভরা একটি কাঠগোলাপ গাছ। গাছটির যেন  দোতলার লাল টালি ছাওয়া সাদা বারান্দাটাকে  ছোঁয়ার প্রয়াস ।

মল্লিকা জানালো –

‘এই গাছের ফুল ছিল তার মায়ের খুব প্রিয়।  মন খারাপ হলেই এই গাছটার নিচে মা চলে আসতেন। আমার মন খারাপ হলে, কেন জানি না, আমিও  চলে আসি গাছটার কাছে, মনটা তখন তার ভালো হয়ে ওঠে, ঠিক যেন মনে হয় মা’র কাছে এসেছি।’

আশপাশে চেয়ে দেখি চত্বরের একপাশে চারটে বাঁশের খুঁটির ওপর তেরপলের ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে আছে একটি ধুলো ঝুলে মলিন গাড় নীল রঙের হাডসন হর্নেট গাড়ি, বহু দিন ব্যবহার হয় নি, চারটে চাকাই বসে গেছে কাঁচা মাটিতে।

বাড়ির ভেতরে ঢুকেই বেশ বড় সড় বসার ঘর,বড় শ্বেত পাথরের তে’পায়া গোল টেবিলের চারপাশে  পাঁচ ছ’টা গদি আঁটা চেয়ার, সিলিং থেকে ঝুলছে একটি ধুলিধূসর কাপড়ে মোড়া ঝাড় বাতি। বসার ঘরের এক পাশ দিয়ে কাঠের চওড়া সিঁড়ি আধ তলা অবধি সোজা উঠে বাঁক নিয়েছে দো’তলায়।  খোঁচা খোঁচা, যেন নুন মরিচ ছড়ানো দাড়ি, হাঁটুর ওপর তোলা ধুতি একজন বুড়ো মতন মানুষ, সিঁড়ির পাশে জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে। মনে হল এই হবে প্রহ্লাদ।আর কাউকে দেখলাম না। মল্লিকাকে বসার ঘরের চেয়ারে বসিয়ে জানতে চাই পুরো ব্যাপারটা।

মেয়েটার  মুখ চোখে কালি পড়ে গেছে। কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে বসে সহজ ভাবে ঘটনাটা বলে –

‘কাল রাতে আপনার বাড়ি থেকে ফিরতেই শুনতে পাই মামা আর দাদুর মধ্যে পরি ত্রাহি চেঁচিয়ে ঝগড়া হচ্ছে। একতলা থেকে টুকরো টুকরো শুনলাম কথা কাটাকাটি পারিবারিক ব্যবসা নিয়ে। দাদু প্রচণ্ড রেগে বলছেন মামার জন্যই এতদিনের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেল। তারপর কথা উঠল মামার বাজারে নাকি প্রচুর দেনা, সেই জন্য এখনই টাকা দরকার আর উইল যখন মামার নামে, তিনি কিছু টাকা চান। দাদু বলছিল মামাকে এক পয়সাও দেবেন না আর উইলও নাকি পাল্টানো হয়ে গেছে, মামা নাকি একটা পয়সা পাবেন না। এরপর শুনলাম দাদুকে শাসিয়ে মামা নিজের ঘরে চলে গেলেন।

আমি ঘুমাতে পারছিলাম না। রাত তখন প্রায়  আড়াইটে। প্রল্হাদ’দা দরজায় ধাক্কা দেওয়ায়, বেরিয়ে শুনি দাদুর ভীষণ শরীর খারাপ, আমাকে ডাকছেন। তাড়াতাড়ি দোতালায় দাদুর ঘরে গিয়ে দেখি উনি সত্যিই অসুস্থ।  জলের গ্লাসটা মেজেতে পড়ে আছে, মনে হ’ল খাটের পাশের টেবিল থেকে জলের গ্লাস নিতে গিয়ে, সামলাতে না পেরে শরীরের সামনের কিছুটা খাট থেকে অনেকটা ঝুলে পড়েছে। প্রহ্লাদদার সাহায্যে কোনোক্রমে দাদুকে খাটে শুইয়ে দিয়ে ছিলাম। দাদু আমাকে ইশারায় কাছে ডেকে অনেক কষ্টে বললেন-

 “ নতুন উইল – আলমারিতে—-।”

এরপর বিছানায় নেতিয়ে পড়লেন। কি করব বুঝতে না পেরে দাদুর ঘরের পাশে  মামার ঘরের দরজায় ধাক্কা দিয়ে চেঁচিয়ে বলি দাদুর অবস্থা। কিন্তু কোনো উত্তর পাই নি। আর কোনো উপায় না দেখে, প্রল্হাদদা কে দাদুর ঘরের বাইরে রেখে রাস্তার মোড়ের নার্সিং হোমের নাইট ডিউটিতে থাকা ড:বোস কে অনুরোধ করাতে তিনি সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ওষুধের ব্যাগ নিয়ে চলে আসেন। দাদুকে পরীক্ষা করে বলেন হার্ট এ্যাটাক হয়েছে এখনই হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। দাদুকে কিছু ওষুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করে বললেন সিনিয়র হার্ট স্পেশালিস্ট ড:চ্যাটার্জি কাছেই থাকেন, তাঁকে আর এ্যামবুলেন্স  এক্ষুনি আনতে যেতে। কিন্তু দাদু তখন ক্রমশ নেতিয়ে পড়লেন আর তারপরই সব শেষ।

 প্রহ্লাদদা আর আমি আবার মামাকে ওঠানোর চেষ্টা করি, এবার তিনি বেরিয়ে সব শুনে আমাদের দুজনকে অযথা গালা গাল করেন, কেন তাঁকে আগে ডাকা হয় নি। এবার আমাদের নিচে যেতে বলে দাদুর ঘরে চলে গেলেন।’

মল্লিকার কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটি গাড়ির আওয়াজ পাই – তার পরপরই বসার ঘরে প্রবেশ করলেন ড:বোস সঙ্গে আর একজন বয়স্ক ভদ্রলোক, তিনি আমার পরিচিত হার্ট  স্পেশালিষ্ট ড:চ্যাটার্জি। তখন প্রায় ভোর পৌনে পাঁচটা।

‘আরে মি:রায়! ভালোই হয়েছে আপনি এসেছেন।’ ড: চ্যাটার্জী বলেন।

 জানালাম আমি মি:সিংহের ল’ইয়ার। ভোরে খবর পেয়ে চলে আসতে হয়েছে। আমরা চার জন তাড়াতাড়ি  সিঁড়ির কাছে পৌঁছতেই কাঠের সিঁড়িতে কারুর নিচে নামার আওয়াজে তাকিয়ে দেখি বছর পঞ্চাশের মাঝারি চেহারার একজন নেমে আসছেন। চুল উসকোখুসকো। পরনে স্লিপিং স্যুট। ভুরু কুঁচকে একটু রূঢ় স্বরে বলেন –

“আমাদের বাড়িতে একটা অঘটন ঘটে গেছে। আপনারা এখানে কেন ?”

আমি নিজের পরিচয় দিলাম। ড:বোস জানালেন তিনি মি: সিংহকে দেখার জন্য কিছুক্ষণ আগে এসে ছিলেন। এখন তাঁর সিনিয়র ড: চ্যাটার্জীকে নিয়ে এসেছেন। মল্লিকা জানালো ইনি ওর মামা প্রশান্ত সিংহ।

‘এত সব ব্যাপার ঘটে গেছে আমাকে না জানিয়ে!’ প্রশান্ত এবার মল্লিকার দিকে কটমট করে তাকিয়ে, আমাদের বললেন –

‘বাবা আর নেই। তাও আপনার ওপরে চলুন, আমি কিছুক্ষণ আগেই ঘরটা বন্ধ করেছি, চাবিটা নিয়ে আসছি।‘

দোতলার উঠেই ডান দিকের সরু বারান্দা ধরে আমরা এগোলাম। বারান্দা ধরে  জাফরি করা লোহার রেলিং। বাড়ির নিচের পিছন দিকটা দেখা যায়। নিচে এক চিলতে অযত্নের  বাগান। বারান্দার ডান দিকের দু’টি ঘর বাদ দিয়ে, শেষ প্রান্তে একটি তালা বন্ধ ঘরের সামনে মল্লিকা দাঁড়িয়ে পড়ল। বুঝলাম এটাই মি: সিংহের ঘর। প্রশান্ত বাবুর চাবি আনতে দেরি হচ্ছে দেখে আমি বারান্দা ধরে পশ্চিম দিকে এগিয়ে গেলাম যেখানে কোমর সমান পাঁচিলের গায়ে বারান্দাটা শেষ হয়েছে। পাঁচিলে ঝুঁকে নিচে দেখি কাদা আবর্জনায় ভর্তি সরু এক চিলতে কানা গলি,  কতদিন সাফাই হয়নি কে জানে। এই গলিটাই সিংহ বাবুর বাড়ি আর পশ্চিমের বড় ফ্ল্যাট বাড়িটার সীমানা। মনে হয় দু’পক্ষই এই এজমালি জায়গাটায় জঞ্জাল ফেলে থাকে। কথাবার্তার আওয়াজে ফিরে দেখি প্রশান্ত বাবু চাবি নিয়ে এসেছেন। পাশের ঘর থেকে চাবি আনতে এত সময় লাগলো কেন কে জানে! হাউস কোট পরা এক মহিলাকেও দেখলাম, সদ্য ঘুম ভেঙে উঠে আসা আলুথালু অবস্থা। জানলাম ইনিই হলেন মল্লিকার মামিমা, জয়শ্রী।

ঘরের ভেতর সবাই এলাম। বেশ বড় ঘর, সিলিং থেকে ঝোলানো বেশ বড়, ঘসা কাঁচের গ্লোব ল্যাম্পের আলো ঘরের চারি দিকে ছড়িয়ে পড়েছে।  এক পাশের আধ খোলা দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছে  ঘরের লাগোয়া ছোট ঝুল বারান্দার এক ফালি। সাদা রেলিঙের ফাঁকে সবুজ পাতার মাঝে বৃষ্টি ভেজা এক গুচ্ছ লালচে সাদা কাঠ গোলাপ হাওয়ায় দুলছে। ঘরের পশ্চিম দিকে দেওয়াল ঘেঁসে পুরনো আমলের দু ধাপ সিঁড়ি লাগানো উঁচু চার ছত্রির খাট।  পাশে মানানসই উঁচু জালি ও ব্র্যাসের কাজ করা কাশ্মিরী টেবিলে ছোটবড় ওষুধের শিশিগুলি ওলটপালট হয়ে আছে আর সে গুলির মাঝে পড়ে আছে জলের গ্লাস ঢাকা দেওয়ার  সাদা নেটের ছোট ঢাকনা। একটি কাঁসার গ্লাস মেজেতে গড়াগড়ি যাচ্ছে, আশপাশের কিছুটা অংশ জলে ভেজা। খাটের ওপর শোওয়ানো সিংহ বাবুর দেহ পা থেকে গলা অবধি নকসা করা শুজনিতে ঢাকা। ড: বোস বললেন দেহটা তিনিই চাদর ঢাকা দিয়ে ড:চ্যাটার্জিকে আনতে গেছিলেন।

ড:চ্যাটার্জি খাটের কাছে গিয়ে শুজনিটা মৃত দেহের গলার থেকে কোমর অবধি সরিয়েই চমকে উঠে বলেন – “একি!”

 সিংহ বাবুর নিথর শরীর চিৎ করে শোওয়ানো, বুকের ওপর দু হাত জড়ো করা, সবাই আশ্চর্য হয় দেখে মি: সিংহের দু হাতের কাদা মাখা আঙুল গুলি সাঁড়াশীর মত একটি জল কাদা মাখা বড় বাদামি রঙের খাম আঁকড়ে ধরে আছে।

ড:বোস আশ্চর্য হলেন –

‘আমি যখন  চাদর চাপা দিলাম,  তখন মৃতের হাতে তো কিছু ছিল না, হাতে কাদাও দেখিনি!’

প্রশান্ত বলে ওঠে–

‘আমিও তো দেখলাম শরীরটা  চাদর দিয়ে ঢাকা হয়েছে। তাই শুধু পা’এ প্রণাম করেই বেরিয়ে এসেছিলাম।‘

ড:চ্যাটার্জী, মি: সিংহকে পরীক্ষা করে, হাত থেকে খামটা বার করার চেষ্টা করে  বললেন-

“এত দেখছি রিগার মর্টিশ শুরু হয়ে কোমর অবধি শক্ত হয়ে গেছে। ওই ছেঁড়া খামটা ডেড বডির আঙুল থেকে বার করা মুশকিল হবে।”

ড: চ্যাটার্জী‘ চিন্তিত হয়ে খাটের একপাশে ড:বোসকে ডেকে নিয়ে নিচু স্বরে কিছু আলোচনা করতে লেগেছেন। আমি তখন ঘরের চারপাশটা দেখছি। দেখি ঘরের অপর দিকের দেওয়াল ঘেঁসে একটি গোদরেজের আলমারির গায়ে এক গোছা চাবি ঝুলছে। মনে হল আলমারিটা তাড়াহুড়োয় খুলে আর বন্ধ করা হয়নি। মনে কিছু সন্দেহ জেগে উঠেছিল। মল্লিকাকে জিজ্ঞাসা করি-

 ‘মি:সিংহ আলমারির চাবি কোথায় রাখতেন তুমি জানো ?’

‘সাধারণত দাদু চাবি রাখতেন তাঁর মাথার বালিশের নিচে।‘ সেও আশ্চর্য হয়ে এবার আলমারির গায় ঝুলে থাকা চাবির দিকে তাকায়।

এবার অসহিষ্ণু স্বরে মহিলা কন্ঠ শুনলাম। মল্লিকার মামিমা আমায় উদ্দেশ্যে বলছেন

‘ শুনলাম আপনি আমার শ্বশুরের উকিল ছিলেন ? এখন তো আপনার এখানে কোনো কাজ নেই। হঠাৎ আপনার এ বাড়িতে আসার দরকার কি পড়ল?  আমাদের উকিল আছেন, কাজটাজ মিটে গেলে পর দরকারী যা করার তিনিই  করবেন।’ গলার স্বর বেশ রুক্ষ। শুনে মনে হল মহিলা আমাকে বিদায় করতে চাইছেন এবং বেশ রুক্ষ স্বরে।

বাধ্য হয়ে বলি তিনি ঠিকই বলেছেন বেশ কিছুদিন আগে মি:সিংহ আমার কাছে কোনো ব্যাপারে কিছু পরামর্শ নিয়ে ছিলেন, তাঁর হয়ে এখন অবশ্য আমার কিছু করার নেই কিন্তু  আজ মল্লিকার উকিল হিসেবে আমি এসেছি। লক্ষ্য করলাম  মামা মামিমা প্রচণ্ড রাগে মল্লিকাকে কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলেন।

এরপরই তাঁদের উপেক্ষা করে খাটের কাছে ড:চ্যাটার্জির কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। ড:চ্যাটার্জী তখন দেহটি পরীক্ষা করছেন। আমি অন্যমনস্ক হয়ে মৃত দেহের পা’এর দিক থেকে চাদরটা ওঠাতেই দেখি সিংহ বাবুর ধুতির জায়গায় জায়গায় জল কাদা লেগে রয়েছে, ছুঁয়ে দেখি বেশ ভিজে, জল কাদা তখনও শুকায়নি। এরপর মৃতের পা’এর দিক চোখ পড়তে চমকে উঠে ড:চ্যাটার্জী ইশারায় ডেকে দেখাই মৃতের দুটো পা’ই ক্ষতবিক্ষত, কাদা মাখা। ডাক্তাররা পরীক্ষা করে আশ্চর্য হয়ে বলেন—

‘পায়ের ছড়ে যাওয়া দাগ গুলিতো পুরনো মনে হচ্ছে না, আবার পা’এর তলাতে ভাঙা কাঁচের ছোট ছোট  টুকরোও ফুটে রয়েছে! মনে হয় সবে হয়েছে। মৃত দেহের আঙুলে আটকে থাকা ছেঁড়া খাম আর বিশেষ করে  হাত পা’এর এই রকম সদ্য হওয়া অবস্থার জন্য পুলিশে খবর দিতে হবে মি: রায়।’  

প্রশান্ত ও জয়শ্রী তীব্র আপত্তি জানাতে থাকে পুলিশে খবর দেওয়া হবে শুনে, কিন্তু ড:চ্যাটার্জী তাদের আপত্তি উপেক্ষা করে লোকাল থানায় ফোন করে দিয়ে  সবাইকে নিচে অপেক্ষা করতে বলেন।

আমরা সবাই নিচের বসার ঘরে চলে এলাম। কৌতূহল বশতঃ: বসার জায়গার ডানদিকের একটি খোলা দরজা দিয়ে দেখি দোতলার মত সরু লম্বা বারান্দা, বাঁদিকে অযত্নের বাগান, ডান পাশে পর পর ঘরের দরজা। প্রথম ঘরটার দরজার পাল্লা দুটো খোলা, মনে হল ঘরটি মল্লিকার, পরেরটা খাওয়ার, তারপরই রান্নাঘর। বারান্দাটা শেষ হয়েছে একটি খিল লাগানো ভাঙা চোরা কাঠের দরজায়। দরজার কাছে গিয়ে দেখি সেটার নিচের অংশের বেশ কয়েকটি  কাঠের ফালি নেই। একটা পুরানো মিট সেফ উল্টে পড়ে আছে এক পাশে, সেটা বোধ হয় ভাঙা দরজাটায় ঠেস দিয়ে দাঁড় করানো ছিল। দরজাটার নিচের খোলা অংশ দিয়ে যে কেউ হামাগুড়ি দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যেতে পারে বাইরের গলিটায়। নিচু হয়ে দেখি গলিটা জুড়ে আন্দাজ ছয় ইঞ্চি উঁচু হয়ে আছে জঞ্জালের স্তুপ।  চিন্তিত হয়ে এরপর ফিরে আসি বসার ঘরে। কোনো সন্দেহের আভাস মাথায় ঘোরা ফেরা করতে থাকে।

একটু অপেক্ষা করতেই, লোকাল থানার ওসি  রোগাসোগা, টুথব্রাশ গোঁফ সাধন সরখেল,  পুলিশের ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে হাজির। তাঁদের  নিয়ে ডা: চ্যাটার্জী দোতলায় উঠে গেলেন। পুরনো কেসের ব্যাপারে পাড়ার থানার ওসি সাধন বাবু আমার পরিচিত। সেই সময় প্রশান্ত বাবু যেন একটু হন্তদন্ত হয়ে ঘরের বাইরে চলে গেলেন কোন কাজে।”

 প্রায় এক ইঞ্চি ছাই জমে নিভে যাওয়া সিগারটা এ্যাস্ট্রেতে ফেলে দিয়ে বীরেনবাবু – হারুকে আর এক রাউন্ড কফি দিতে বলে শুরু করেন।

“ প্রায় ঘন্টা খানেক পর, নিশানাথ বাবুর দেহ নিয়ে পুলিশের ডাক্তার চলে গেলে, থানার ওসি সাধন বাবুর অনুমতি নিয়ে সবাইকে বসতে বলি। প্রশান্ত ও তাঁর স্ত্রী জয়শ্রী রাজি হচ্ছিলেন না কিন্তু সাধন বাবু একটু কড়া হতে তাঁরা অনিচ্ছা সহকারে  আমাদের একটু অপেক্ষা করতে বলে জানালেন তাঁদের উকিলের সঙ্গে কথা হয়েছে তিনিও যে কোন সময় এসে পড়বেন। ’

সমর ডাক্তার ‘একটু আসছি’ বলে ঘরের বাইরে গিয়েছিলেন, ফিরে এসে বললেন- ‘আকাশের অবস্থা ভালো নয়, বাকিটা পরের শনিবার হবে, কি বলো বীরেন ?’ – তখনি  বসার ঘরের গ্র্যান্ড ফাদার ক্লকের একটা ঘন্টার নির্ঘোষ ভেসে এল। অপরে বাবু হাতঘড়িতে চোখ বুলিয়ে বললেন – ‘ হ্যাঁ, এদিকে রাত সাড়ে ন’টাও হয়ে গেল।”

পরের শনিবার আবার বসা হবে ঠিক করে, সবাই যে যার বাড়ির দিকে রওনা দিলেন।

পরের শনিবার যথারীতি তিন বন্ধু ঠিক সময় বীরে বাবুর বাড়ি হাজির হয়েছেন। লাইব্রেরীতে স্ট্যান্ড ল্যাম্পের সবুজ সেড চুঁইয়ে হালকা সবজে আলোর আভা ঘরের ক্রীম রঙের দেওয়ালে, বইয়ের আলমারি গুলিতে আলো ছায়া তৈরী করেছে। স্ট্যান্ড ল্যাম্পের নিচে বীরেন বাবু তাঁর নির্দিষ্ট চেয়ারে বসে। সেডের নিচে  নেমে আসা খানিকটা তেরছা আলোয় তাঁর চোখে মুখ আলো আঁধারিতে যেন রহস্যময়।

হারু কফি নিয়ে আসার পর, বীরে বাবু তাঁর প্রিয় Asthon সিগার ধরিয়ে যুত হয়ে বসে শুরু করলেন–

“ তখন প্রায় বেলা এগারোটা বেজে গেছে। বাইরে একটা গাড়ি থামার আওয়াজ, তার একটু পরেই দেখি একজন মহিলা, বয়স আন্দাজ পঞ্চান্ন ছাপ্পান্ন, কিঞ্চিত স্থুলাঙ্গী, হাতে একটা ছোট সুটকেস, হন্তদন্ত হয়ে ঢুকলেন। তাঁকে দেখেই মল্লিকা   ‘মাসি ‘বলে ডেকে মহিলাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল আর প্রশান্ত উঠে দাঁড়িয়ে ‘ আরে দিদি! তুই খবর পেলি কখন ? ‘ শুনলাম মহিলা বলছেন কয়েক দিন আগে নিশানাথ বাবু তাঁকে চিঠি পাঠিয়ে তাড়াতাড়ি কোলকাতায় আসতে বলেছিলেন আর আজ মল্লিকা ভোর রাতে তাঁকে খবর জানাতে দিল্লী থেকে প্রথম ফ্লাইটে  চলে এসেছেন। আবার দেখলাম প্রশান্ত, জয়শ্রীর চোখে মুখে অসন্তোষের ছায়া। একটু পরেই আর একজন মাঝবয়সি ভদ্রলোক এসে গেলেন,  ভদ্রলোক তাঁর উকিল পরিচয় জানিয়ে প্রশান্ত একটি বড় খাম তাঁর হাতে দিয়ে দিলেন ।

যাই হোক সাধন বাবু সংক্ষেপে  ঘটনার বিবরণ দিয়ে বললেন- তাঁরা দেহটি পরীক্ষার জন্য নিয়ে গেছেন আর তদন্তের রিপোর্ট পেতে কিছু সময় লাগবে। এবার তিনি শুরু করতে বলাতে, আমার বক্তব্য শুরু করলাম ।

প্রথমেই জানালাম – মাস তিন চার আগে আমার বন্ধু সলিসিটরের অফিসে নিশানাথ বাবুর সাথে পরিচয় হয়। তাঁর বৈষয়িক ব্যাপারে কিছু পরামর্শ দরকার ছিল আর তিনি একটি নতুন উইল করতে চান।

উকিল ভদ্রলোক সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন –

 ‘ নতুন উইল মানে ? আমার ক্লায়েন্টের কাছে নিশানাথ বাবুর জীবদ্দশায় করা এই উইলটাই আছে। সুতরাং দ্বিতীয় উইলের প্রশ্নই ওঠে না।’

এবার তিনি প্রশান্ত বাবুর দেওয়া বড় খামটা তুলে দিলেন সাধন বাবুর হাতে। তিনি আবার খামটা আমাকে দিলে, দেখি খামের ভেতরের কাগজগুলি উইলই বটে কিন্তু সেটা বাতিল হয়ে যাওয়া প্রথম উইল যেখানে পুরো সম্পত্তি প্রশান্তকে দেওয়া হয়েছে আর মল্লিকার জন্য সামান্য মাসোহারর ব্যবস্থা রয়েছে।

মনটা আমার অশান্তিতে ভরে উঠল।তখন আর কোনো উপায় না দেখে সাধন বাবুকে বললাম –

‘ একবার সিংহবাবুর আলমারিটা সবার উপস্থিতিতে দেখা যেতে পারে ? কারণ তাঁর নির্দেশে কয়েক মাস আগে দ্বিতীয় উইল করা হয়েছিল আর আমিই সেই উইল করে দিয়ে ছিলাম।’

প্রশান্ত আর তাঁর উকিলের সরব প্রতিবাদ উপেক্ষা করে সাধন বাবু বললেন –

‘মি: সিংহের মৃত্যুর কারণ  স্থির না হওয়া অবধি সব রকম সন্দেহের তদন্ত হওয়া দরকার।’

এরপর তিনি সবাইকে সিংহবাবুর ঘরে আসতে বলে দোতলায় চলে গেলেন। দোতলার ঘরে গিয়ে দেখি গোদরেজ আলমারির গায়ে চাবির গোছাটা তখনও ঝুলছে। সাধন বাবু চাবিটা খুলে নিজের কাছে রেখে আলমারি খুলে,  লকারের ভেতরে রাখা সব কাগজপত্র বার করে কাছের টেবিলে রাখলেন। আমরা সবাই ঝুঁকে পড়ে দেখি – কিছু চেকবই, পুরনো পাশ বই, বাড়ির দলিল আর কয়েকটা অদরকারী কাগজ ছাড়া  আর কিছু দেখা গেল না, টাকা পয়সাও কিছু নেই।

প্রশান্ত বলল –

‘বাবা কয়েক দিন আগে এই উইলটা আমার কাছে রাখতে বলেছিলেন।‘

বেরিয়ে আসার আগে মল্লিকাকে চিন্তা করতে বারণ  করে সাধন বাবুকে বলি – মৃতের হাতে আটকে থাকা খামটা বার করা গেলে আমাকে খবর দিতে।

পরের দিন দুপুর বেলা সাধন বাবুর আর্জেন্ট ফোন পেলাম –

‘মি:রায়- ডাক্তারের রিপোর্ট পাওয়া গেছে আর মৃতের হাতের আঙুলে আটকে থাকা খামটাও বার করা হয়েছে। আপনি সন্ধ্যে ছটা সাড়ে ছটার মধ্যে সিংহ বাড়ি  চলে আসুন। রিপোর্ট আর ছেঁড়া খামটা সিংহ বাবুর বাড়ির লোকের কাছে  দেওয়ার আগে একটু আলোচনা করতে হবে।’

“এরপরই ফোন এলো মল্লিকার থেকে। শুনলাম প্রশান্ত ওকে আগামী পনেরো দিনের মধ্যে কোনো মহিলা হস্টেলে চলে যেতে বলেছে, হস্টেলের খরচা ইত্যাদি উইল অনুযায়ী মল্লিকার পাওনা মাসোহারার থেকে দিয়ে দেওয়া হবে। মেয়েটাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলি ওদের বাড়িতে আজ সন্ধ্যেবেলা আসছি, এসে আলোচনা করবো।

মনের ভেতর চিন্তা ঘুরপাক খেতে থাকে, দ্বিতীয় উইলটা গেল কোথায় ?

সাধন বাবুর কথা মত পৌঁছে গেলাম সিংহ বাড়িতে। ঝিরঝিরে বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছে। দেখি প্রশান্ত বাবুর উকিল ভদ্রলোক ইতিমধ্যে এসে এক তলার বৈঠক খানায় বসে আছেন। সেখানে কথা বলা যাবে না বুঝে মল্লিকাকে  নিয়ে বসার ঘর থেকে বাইরে যাওয়ার দরজার কাছে  এসে দাঁড়ালাম। তখন ঝিরঝিরে বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছে। মেয়েটির চেহারা দেখে বুঝলাম তাকে গতকাল থেকে  প্রচণ্ড মানসিক অত্যাচারের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।

মল্লিকাকে মনের জোর আনার চেষ্টা করতে বলে জিজ্ঞাসা করি-

‘গতকাল বলেছিলে আলমারির চাবি সিংহ বাবুর  মাথার বালিশের নিচে থাকত আর উনি তোমাকে প্রায় শেষ অবস্থায় বলেছিলেন আলমারিতে নতুন উইল আছে। এবার বল তুমি গতকাল রাতে যখন ঘরে গেছিলে – আলমারিতে চাবি ঝুলতে দেখেছিলে’ ?

‘–আলমারির দিকে নজর করার মত সেই সময় মনের অবস্থা যা ছিল না বা মাথাতেই আসে নি। আর স্পষ্ট মনে আছে দাদু কে খাটে ঠিক করে শোওয়ানোর সময় বলেছিলেন – আলমারিতে নতুন উইল আছে।  নিশ্চিত করে বলতে পারি সে সময় দাদুর শরীরের যা অবস্থা ছিল, তাঁর পক্ষে বালিশের নিচ থেকে চাবি নিয়ে, অতটা হেঁটে আলমারি খোলা একেবারেই অসম্ভব ছিল।’ এবার কেঁদে ফেলে মল্লিকা –

‘মামা আজ সকালে আমায় বলে দিয়েছে পনেরো দিনের মধ্যে লেডিজ হস্টেলে উঠে যেতে আর মাসিকে বলেছে কালই দিল্লী চলে যেতে কারণ মাসির নাম নাকি উইলে নেই। আবার প্রহ্লাদদার কাছে শুনলাম মামা নাকি এই বাড়ি বিক্রি করে দেবে। তাই প্রহ্লাদাকেও এক মাস পর আর রাখা হবে না। ’

তখনই সাধন বাবুর জিপ এসে থামল বাড়ির সামনে। মল্লিকাকে সঙ্গে নিয়ে সাধন বাবুর সঙ্গে বসার ঘরে এসে দেখি প্রশান্ত ও জয়শ্রী দুজনেই ততক্ষণে নিচে এসে তাঁদের উকিলের সাথে কিছু আলোচনা করছেন। মল্লিকার মাসি উদাস দৃষ্টি মেলে  বসে আছেন একটা চেয়ারে। প্রহ্লাদ এক কোনে শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে। সঙ্গীতার অবর্তমানে উপলব্ধি করি মল্লিকার প্রতি একটা অদ্ভুত টান আর দায়িত্ব বোধ ক্রমশ যেন চেপে বসছে আমার মনে।

সাধন বাবু বেশ পুলিশি মেজাজে কথাবার্তা শুরু করলেন। হাতে ধরা কাগজগুলির  একটিতে চোখ বুলিয়ে  গম্ভীর স্বরে প্রশান্ত বাবুকে বললেন –

‘ প্রথমে বলি আমাদের ডাক্তারদের রিপোর্ট অনুযায়ী সিংহ বাবুর মৃত্যু হয়েছে পর পর দুবার হার্ট এ্যাটাকে। কিন্তু পায়ে ছরে যাওয়া বা  পায়ের তলায় ফুটে থাকা কাঁচের টুকরো  থেকে ক্ষত গুলো হয়েছে মৃত্যুর পরে। সে গুলো কি ভাবে হতে পারে তার কারণ অজানা।’

সাধন বাবুর হাত থেকে রিপোর্টটা চেয়ে নিয়ে পড়ে দেখলাম ডাক্তারদের মন্তব্যে ক্ষত চিহ্ন বা কাঁচের টুকরো ফুটে থাকা নিয়ে বলা হয়েছে – ‘মৃত্যুর পরে পায়ের ক্ষতর কারণ অজানা’।

আমার সন্দেহটাই সত্যি হয়ে দাঁড়ালো।

এরপর সাধন বাবু কাদা মাখা ছেঁড়া খাম থেকে দু তিনটে স্টেপল করা, মাঝখান দিয়ে প্রায় দু ফালা হওয়া কাগজ বার করে আমার হাতে দিয়ে বললেন –

‘ এই কাগজ গুলোয় দেখলাম সিংহ বাবুর সইয়ের সাথে আপনারও নাম রয়েছে সুতরাং আপনিই এখন সবাইকে এর বিষয়বস্তুগুলি  বলতে পারেন।’ তখন পুলিশের ডাক্তারের রিপোর্টটা প্রশান্ত ও উকিল ভদ্রলোক দেখতে ব্যস্ত।

ছেঁড়া কাগজ গুলো চোখ বোলাতেই পুরো ঘটনাটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো।

সাধন বাবুকে বললাম – ‘ এটা পড়ে শোনানোর আগে আপনার সঙ্গে একটু আলাদা কথা বলতে চাই।’

তাঁকে সিঁড়ির কাছে ডেকে নিয়ে আমার সন্দেহটা বিস্তারিত করে বলাতে তিনি অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে ঘরের ভেতরে থাকা কনস্টেবল কে জিপ থেকে বড় টর্চটা নিয়ে আসতে বলেন। এবার সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলেন –

‘ একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে তদন্তের জন্য আপাতত দ্বিতীয় কাগজটা পড়া কিছুক্ষণ বন্ধ রাখছি।‘ এরপর প্রহ্লাদ কে ডেকে নিয়ে, আমাকে ইশারায় আসতে বলে এক তলার বারান্দায় যাওয়ার দরজাটার দিকে এগিয়ে গেলেন’

এক তলার সরু বারান্দা ধরে শেষ প্রান্তের ভাঙা দরজাটার কাছে পৌঁছে সাধন বাবু দরজার চাবিটা প্রহ্লাদকে আনতে বললেন। এর মধ্যে অন্ধকার নেমে এসেছে। বৃষ্টিরও গতি বেড়েছে। প্রহ্লাদ মরচে ধরা একটা চাবি নিয়ে এলে অনেক চেষ্টা করেও তালাটা খোলা গেল না, জং ধরে গেছে। সাধন বাবু তখন কনস্টেবলকে দরজাটা খোলার চেষ্টা করতে বলাতে, সে বার’দুয়েক জোরে ধাক্কা মারতেই বহু দিনের না খোলা জলে ভিজে জীর্ণ হয়ে যাওয়া দরজার একটা পাল্লা ভেঙে একদিকে ঝুলে পড়ল। পুলিশের জোরালো পাঁচ সেলি টর্চের আলোয় দরজার সামনে জমে থাকা আবর্জনার স্তুপে দেখা গেল নাড়া চাড়ার চিহ্ন। দেখা গেল  জঞ্জালের ওপর  ছড়িয়ে রয়েছে বেশ কিছু ভাঙা কাঁচের টুকরো, টর্চের জোরালো আলোয় বৃষ্টি ভেজা ছড়ানো ছিটানো কাঁচের টুকরো গুলো যেন হিরের কুঁচির মত ঝলমল করছে।

সাধন বাবুর তখন –‘ আশ্চর্য আশ্চর্য’ ছাড়া  মুখে আর  কোনো শব্দ নেই।

ফিরে আসা হল বসার ঘরে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে ও দাঁড়িয়ে থাকা মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে, জল কাদা শুকিয়ে যাওয়া ছেঁড়া খামের ভেতরের দু টুকরো হওয়া কাগজ গুলো বার করি। চেনা কাগজে একবার চোখ বুলিয়ে, সাধন বাবুর অনুমতি নিয়ে সংক্ষেপে বলি–

‘নিশানাথ বাবু প্রথমে তাঁর একমাত্র ছেলের নামে সব কিছু উইল করে দিয়েছিলেন বছর পাঁচেক আগে। সেই উইলে তিনি বড় মেয়ে শর্মিলাকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত করেন তাঁর অমতে বিয়ে করার জন্য। তাঁর দ্বিতীয় মেয়ে সঙ্গীতাকে যদি দরকার হয় এই বাড়িতে থাকার আর সাথে কিছু মাসোহারার ব্যবস্থা রেখেছিলেন। সেই প্রথম উইলটা প্রশান্ত বাবুর হাতে কি ভাবে কিছুদিন আগে এলো সেটা তদন্ত সাপেক্ষ কারণ মাস তিনেক আগে নিশানাথবাবুর মত পরিবর্তন হয়।’

প্রশান্ত বাবুর উকিল ঘোরতর প্রতিবাদ আরম্ভ করলেন। প্রশান্ত উত্তেজিত হয়ে প্রায় মারমুখী হয়ে উঠলেন তাঁদের পারিবারিক বিষয় না জেনে আর উইল নিয়ে এইসব কথা বলার জন্য। সাধন বাবুর হস্তক্ষেপে পরিবেশ একটু শান্ত হলে আবার শুরু করি –

‘ এরপর মাস তিনেক আগে নিশানাথ বাবু তাঁর সলিসিটরের মাধ্যমে আমার সঙ্গে দেখা করে তাঁর বর্তমান অবস্থা ও প্রথম উইল নিয়ে আলোচনা করে একটি নতুন উইল করবেন ঠিক করেছিলেন।’

প্রশান্ত বাবু আবার উত্তেজিত হয়ে উঠতে সাধন বাবুর পুলিশি দাবড়ানিতে চুপ করে গিয়ে মাথা চেপে ধরে বসে পড়লেন।

‘তিনি এবার কিছু পারিবারিক কারণে ঠিক করলেন –  তাঁর সব কিছু,  বহু বছর সম্পর্ক বিচ্ছিন্না বড় মেয়ে শর্মিলা,তাঁর মৃতা মেয়ে সঙ্গীতার এক মাত্র মেয়ে মল্লিকা যে তাঁর বাড়িতেই থাকে, তাদের মধ্যে সমান ভাগ হবে আর তাঁর বহু দিনের কাজের লোকের জন্য পেনশনও ঠিক করলেন। অবশ্য তাঁর ছেলে প্রশান্তকে একেবারে বঞ্চিত করেন নি, তাঁর কিছু মাসোহারার ব্যবস্থাও করলেন। কিন্তু তিনি নতুন উইল ও  তার শর্তগুলি গোপন রাখতে বলেছিলেন।’

প্রশান্ত ও জয়শ্রী এক যোগে মিথ্যে কথা, মিথ্যে কথা বলে চেঁচামেচি শুরু করল। ওদের উকিল দাবি জানালো নতুন উইল কোথায়।

তখন সেই দুফালি কাগজগুলি এক সঙ্গে জড় করে পড়ে শোনালাম।

এবার সাধন বাবুকে  বলি –

‘ মল্লিকার হয়ে আমার কাজ শেষ হল। তবে আপনার কিছু কাজ রয়ে গেছে  —

 প্রথম হলো প্রশান্ত বাবুর বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থার খোঁজ আর নিশানাথ বাবুর আলমারি খুলে নতুন উইলটা গতকাল কে সরিয়ে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিল খুঁজে বার করা ?

 দ্বিতীয়টা হলো মৃত নিশানাথবাবুর হাতে সেই জল কাদা মাখা ছেঁড়া দ্বিতীয় উইল এল কি ভাবে ?

আর – আর – তৃতীয় — মৃতের কাপড়ে জল কাদা লেগে থাকা,  শরীরে ছড়ে যাওয়ার দাগ আর পায়ের তলায় কাঁচ ফুটে থাকা চিহ্নই বা কি করে সম্ভব যখন  ডাক্তারের মতে সেগুলি হয়েছে মৃত্যুর পর ?

এখন বলা যেতে পারে নিশানাথ বাবুর ঘরে বা ঘরের বাইরে জল কাদা বা ভাঙা কাঁচ আমাদের চোখে পড়েনি যদিও পাশের গলিটা জঞ্জালে ভরা, যেখানে দেখা গেছে ভাঙা কাঁচের টুকরো ছড়ান। আমার মনে হয় দ্বিতীয় আর তৃতীয় ঘটনা কি ভাবে ঘটেছে তার সদুত্তর রহস্যই থেকে যাবে।’

প্রশান্ত বাবু প্রায় অচেতন হয়ে বসে রইলেন চেয়ারে। সাধন বাবু আর প্রশান্তের উকিল কি বলবে ভেবে পাচ্ছেন না। জয়শ্রী পাথরের মত বসে থেকে  হঠাৎই বিকার গ্রস্থ অদম্য কান্নায় ভেঙে পড়ে চেতনা হারালেন। 

এই সময় হঠাৎ এক ঝলক বৃষ্টি ভেজা বাতাসে, সঙ্গীতার প্রিয়  কাঠগোলাপের গন্ধ ভেসে এসে ঘরের  গুমট আবহাওয়া যেন সরিয়ে নিয়ে গেল

বাইরে বেরিয়ে এসে অজান্তে চোখ চলে যায় ঝিরঝিরে বৃষ্টি ভেজা সঙ্গীতার প্রিয় গুচ্ছ গুচ্ছ কাঠগোলাপ ফুটে থাকা গাছটির দিকে। ফুল গুলো বৃষ্টি ভেজার আনন্দে দুলে দুলে  যেন বুঝিয়ে দিচ্ছিল সঙ্গীতা এতদিনে যেন নিশ্চিন্ত হয়েছে।”

লাইব্রেরীতে নিস্তব্ধতা ঘন হয়ে উঠেছে। সবাই যেন কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। সমর বাবু তখন স্থির হয়ে বসতে পারছেন না চেয়ারে।

বীরেন বাবু কিছুক্ষণ মৌন থেকে মুচকি হেঁসে বলে উঠলেন –

“ কি হে ডাক্তার ? রহস্যটা কি ব্যাখ্যা সাধ্য মনে হচ্ছে ? আবার তোমায় মার্ক টয়েনের কথাতেই বলি –সত্য , কল্পনার থেকে অনেক বিস্ময়কর ঘটনা যা বললাম সেটা বিস্ময়কর সত্যের মধ্যেই পড়ে হে !!”

                                        —————XXXX——————

( **)  “চাঁদনী” গল্পটা আমার “সাত সতেরো” বইতে আছে – www.sanjibchakraborty.in

-Advertisement-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here