-Advertisement-

                                                   নয়নের দিনরাত্রি

“লয়ন, ও লয়ন উঠবি নি !সূয্যি ঠাকুর উঠি পড়তিছে যে ! উঠরে বাপ, মাঝির তাড়া খাবি যে। ”

ফুলমনি ব্যস্ত হয়ে ছিটাবেড়া ঘেরা তাদের ছোট উঠানে কুঁচিকাঠির ঝাঁটা চালায় আর গজ গজ করে নিজের মনে-

 “ কবে যে বিলের কুঁচির ঝোড়ে যাওয়া হবেক ! আগে বুঢ়াডা গাঁও মাঝির গাই গুলান চরাতে যেত – গাঁয়ের বাইরের মজা বিলের ধারে বেড়ে ওঠা কুঁচির গোছা লয়ন  লিয়ে আসতো। এখুনতো বুঢ়াডারে ঘরে একা ফেলে যেতি হবি। পাইকার বাবু তাড়া দেয়। কথা মতন পচাশটা ঝাঁটা না দিলে, দাদনের ট্যাকা ফিরাতে হবেক। কি যে করি !“

নয়ন ছেঁড়া চাটায়ে শুয়ে আছে চোখ মেলে। ওপরের খাপরা চালের অজস্র ফুটফাটায় কাক ভোরের আকাশের টুকরো দেখে সে। উঠেই পড়ে নয়ন।  না: আজ বিল থেকে কুঁচি নিয়ে আসতেই হবে।

 মা’র আগের রাতে গুছিয়ে দেওয়া গামছায় বাঁধা মুড়ি আর ডেলা খানেক গুড় নিয়ে বেরিয়ে পড়ে নয়ন। তাদের আসনপানি গ্রাম মাঝির গরু চরায় সে এখন। আজ বেশ কয়েক মাস বাপ কাজে যেতে পারে না। বাপটা কি যে ব্যায়রাম বাধিয়েছে মারাংবুরু দেওতাই জানেন। মোড়লের গরু না চরালে, মাসের শেষে যে’কটা ট্যাকা পাওয়া যায় তাও বন্ধ হয়ে যাবে। তাই এই কয়েক মাস ওই দূরের ধূমল নীল পাহাড় আর জঙ্গলে ভরা হাতির মাথার মত  গজঅ ডুংরী গুলোর মাঝ দিয়ে আঁকাবাঁকা বয়ে যাওয়া সরু লদী সাতগুরুং  ধারে আকাশমণির জঙ্গলে  গ্রাম মাঝির গরুগুলোকে চরা’তে নিয়ে যায় নয়ন।

গাঁ’এর শেষ মাথায়, তেঁতুল গাছটার- ছাওয়ায় অড়লফুল ঝোড়ের মাঝে খোলা জায়গার পাঠশালাটায়  নয়ন আর যেতে পারে না।  নয়নের ভালোই লাগতো পড়তে যেতে, পড়ার শেষে পেট ভরে ভাত ডাল খাওয়ায়। গাঁ’এর  কুড়ি বাইশজন ছেলেমেয়ে সচারচর কামাই করে না ওই পেট ভরে খাওয়ার লোভে। 

গ্রামের মধ্যে দিয়ে কাদা জমে শক্ত হওয়া ধূসর রাস্তাটা চলে গেছে সোজা সেই তেঁতুল গাছের পাশ দিয়ে গ্রামের বাইরে। তারপরই রাস্তাটা  লাল নুড়িমাটির, গরুরগাড়ির চলাচলে, পিঠে কুঁজ নিয়ে  ওঠা নামা রাস্তাটা , এঁকে বেঁকো চলে গেছে সেই দূরের নীল পাহাড় পানে। মাথায় জঙ্গল নিয়ে দাঁড়িয়ে  প্রথম গজঅ ডুংরীটা পেরোলেই সাতগুরুং লদী।  মারাংবুরু পাহাড় থেকে নেমে আসা সাতটা ঝোরা,  লদী হয়ে বয়ে চলছে কতদূর্ কে জানে, নয়ন জানেনা। গ্রাম মাঝিবুঢ়াও  বলতে পারেনি। তবে বলেছিল গাই ছাগল চরাতে বা কেঁদু পাতা তুলতে কখনই যেন সাত ঝোরা পাহাড়ে কেউ না যায়। ওখানে নাকি নাইহার বোংগা থানা গেড়ে আছে। ওর বাপও মানা করে দিয়েছিল যেদিন নয়ন প্রথম গাই চরাতে যায়।

নয়ন এখন চলেছে পনেরো কুড়িটা গাই, বকনার  পিছনে। বাঁশের  ছিপটি আস্ফালনে তাদের লালমাটির পথের বাইরে যেতে দেয় না। পথের দু ধারে ভুট্টার ক্ষেতি। রেতের বেলা গাঁয়ের ছেলে বুঢ়াগুলান পালা করে ক্ষেতি পাহারা দেয় নইলে পাশের বনের হরিণরা এসে খেয়ে যাবে সব, হাতিরাও আসে যখন ফসলে ধরে সোনার রঙ। নয়নকেও পাহারায় যেতে হয় মাঝে মাঝে।

সাদার ওপর কালো ছোপ ছোপ বুধিয়া গাই তার খুব প্রিয়। বুধিয়া জানে লদীর ধারে কোথায় সরেস ঘাস আছে।  অন্য গাইদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে সে। নয়ন একবার দেখে নেয় তার হাঁটুর ওপর তুলে পরা ধুতির গেঁজে নিজের বানানো মূলি বাঁশের আড় বাঁশীটা ঠিকঠাক আছে কি না। সাতগুরুং লদীর ধারে আছে আকাশমণির জঙ্গল। গাছের  ছাওয়া বসে বাঁশী বাজায় নয়ন। গাইগুলান চরে বেড়ায় সাতগুরুং এর পারে। লম্বা লম্বা পা’য়ে ধোক পাখির জোড়, পোকার খোঁজে ঘোরেফেরে গাই এর দলের পেছনে। বাঁশীর সুর লদীর ধারের আকাশমণির জঙ্গল, ওপারে এক ফালি রুখুসুখু জমি ঘেঁসা মৌউলের বন, বনবাবু বলে তমাল বন, ওই ঘন বন  ছুঁয়ে  ভেসে যায় দূর নীল পাহাড়ের চুড়ায় চুড়ায়।  বুধিয়া তার পাশে বসে  শিং নেড়ে ঘাসপোকা তাড়ায় আর আনমনে শোনে নয়না। নয়নের মামারবাড়ির গাঁও মেঘদহ। তার মা ফুলমণির সই’য়ের মেয়ে নয়না। সে তাদের ছাগলগুলো চরাতে নিয়ে আসে নদীর ধারে। ফ্যাকাশে দু ফালি সরু  সবুজ পাড়ের সাদা থান কাপড়ের ‘ফাতা’য় মোড়া রোগাসোগা শরীর, রুলি পরা দুটো  চিকন কালো হাত বেরিয়ে আছে গাছকোমরে পরা কাপড়ের ফাঁক দিয়ে। এক ঢাল রুখু চুলের বেণী লতিয়ে আছে তার পিঠের পরে। কানে লোহার তারের মাকড়ি। নাকে পুঁতির নাকছাবি। শুকনো লাল আবির রঙা ধুলোয় মাখা পা’য়ের গোছ। সূয্যি ঠাকুর মাথার উপর উঠলে, গাছের ছাওয়া  জড় হয় আকাশমণির গুঁড়ির চারপাশে। আকাশমণির জঙ্গলে গাই ছাগলের চরে বেড়ানোয় দৃষ্টি রেখে নয়না বসে থাকে তার পাশে, তার নানা কথা শুনতে হয় নয়নকে।

মাঝে মাঝেই বলে ফেলে তার মনের অনেক কথা।

নিয়ম মত গাঁয়ের যোগমাঝির সাথে  মা’র কথায় তাকে যেতে হয়েছে টুসুর মেলায় বরের খোঁজে । কাছে পিঠের গাঁও থেকে মেয়েরা আসে কত সেজেগুজে। তাদের মাথায় গলায় লাল পলাশ, হাতে রঙবেরঙের রেশমী চুড়ি, গলায় দোলে পলাশ বীজের মালা, হরেক রঙের গাছ কোমরে পরা শাড়ি, পায়ে রুপালী মল। তারা দল বেঁধে নাচে। পুরুষদের পরনে হলুদে ছোপানো নতুন  ধুতি। ধামসা-মাদলের ছন্দে দুলে ওঠে শরীর ও মন, ছেলেদের তেল চুকচুকে চুলের গোছা নাচের তালে তালে ঝাঁপিয়ে পড়ে চোখেমুখে। নয়না বরাবর থেকে যায় নাচের দলের বাইরে। মেয়ে পুরুষদের  দল যেন হাওয়ায় ভাসে  – ধীরে ধীরে মুখোমুখি হয়ে,  আবার পিছিয়ে আসে – গানের সুরে, ধামসার তালে তালে। । সে দূর থেকে দেখে কিন্তু এগিয়ে যেতে পারে না। এবার সে তার বাঁ’পা টা দেখায় নয়ন কে।  ওই পা টা যেন শুকিয়ে বুনো শিয়াকুলের ডাল। ছোটবেলায় গাঁ’এর সোরেন হাড়াম জবাব দিয়েছিল। নয়নার বাপ ধারকর্জ করে তাকে নিয়ে গেছিল বাঘমুড়ির সরকারের হাসপাতালে। কিন্তু কাজ হয় নি। নয়না তাই জোর পায় না বাঁ পায়ে। একে একে মনের মত বর পেয়েছে তার অনেক সই। যোগমাঝি আশা ছেড়ে দিয়েছে সেই কবে।  কথার শেষে নয়নার উদাস চোখ আকাশমণির ডালপালার ফাঁকের নীল আকাশের জাফরির থেকে সরে গেছিল মৌউল বনের গভীর ঘন সবুজে।

নিঝুম দুপুর, দূর থেকে ভেসে আসা তিলা ঘুঘুর একটানা ডাক, দুপুরের নির্জনতা ঘন করে তোলে। লদীর ধারের আকাশমণির ডালপালার ফাঁকে নীল আকাশে উদাস চোখ, আড়বাঁশীতে গানের সুর শোনে নয়না।

কালো জলে কুচলা তলে ডুব দেয় আসনপানির লয়ন
আজ সারা না, কাল সারা না পাই যে দরসন৷
লদীধারে আকাশমণি , মৌউলির  বন – বঁধু মিছাই কর আস
ঝিরিহিরি আঁকাবাঁকা সাতগুরুং বইছে বারমাস৷

পা’য়ের পাতা ডোবা নদীর জলে ছড়ানো পাথরগুলো কালো কুচকুচে কাছিমের পিঠের মত জেগে আছে ইতিউতি। নিথর দুপুর, আকাশের নীল ছায়া জমা নিস্তরঙ্গ জলে খেলে বেড়ায় ছোট ছোট রুপোলী কুচো মাছের দল। নয়ন গামছায় মাছ ধরে, নয়না অবাক হয়ে দ্যাখে। নদীর ধারে বেড়ে ওটা কচু পাতায়  ধরা মাছ নয়নার সাথে ভাগাভাগি করে নেয় নয়ন।

 ফেরার সময় নয়না কুড়িয়ে রাখা কেঁদু পাতার গোছা  ছাগলের  পিঠে রেখে, ফেরে তার গ্রামে। সূয্যি ডোবার আগে ফিরতে হয় গাঁয়ে।  আঁধার নামলে পথে হুড়ার, বনশুয়োরের ভয়, দল ছাড়া হাতিও কখনো পথ জুড়ে দাঁড়ায়।

অস্তগামী সূর্যের কমলা আলো ছড়িয়ে পড়ে  গরুর ক্ষুরে ওড়া  ধুলোয়, সেই রেশ নয়নার কাজল কালো  হরিণ  চোখে ফোটায় মায়াবী আলো। নয়নের  কিশোর মনে সেই আলো কোন অজানা দিশার সন্ধান নিয়ে আসে।  

বুধিয়া গাই পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে গাঁয়ের পথে – নয়নার ছাগলের দল মিশে যায় গরুর পালে। নয়ন তার আড় বাঁশীতে আবার গানের কথার সুর তোলে –

 “বাঁশুরিয়া বাঁশী ফুঁকে মাদ্যোল্যা মাদল

পাহাড়িয়া লদী শুধু

বহে কল কল

আমার মনের বাগে

ফাগুনের আগুন

তোলপাড়া করে মন

হিয়া থর থর

সাঁজবেলি রঙ মাখ্যে

গগনে মগনে

বাঁশী শুন্যে মজে মন

 —–“

খুঁড়িয়ে চলা অলস পায়ে নয়নের পাশে পাশে এগিয়ে চলে নয়না। আর কয়েক কদম এগিয়েই তারা আলাদা হয়ে যাবে যে যার গাঁ’য়ের পথে।

গ্রাম মাঝির গোয়ালে গরু তুলে, ধুনো দিয়ে, দিনমজুরের খোরাকি এক সাঁনকি লাল মেটে চাল, দুটি চুরকা-আলু আর কাগজে মোড়া খানিকটা নুন হাতে তুলে দেয় মাঝি বউ। তার আগে মাঝির উঠানে উড়ে আসা পাতা, ডালপালাও ঝেঁটিয়ে দিয়ে ছুটি পায় নয়ন। সাঁজের আলো নিভে গিয়ে অন্ধকার নেমে আসে গাঁয়ে, আশেপাশের জঙ্গলে, কাছের গজঅ ডুংরির গায়ে।  গোয়ালের বাতার ফাঁকে গামছায় বেঁধে রাখা কচু পাতায় মোড়া কুচো মাছগুলো নিয়ে অন্ধকারে ঘরের পানে হাঁটা দেয় নয়ন। 

খাপরা চালের ছিটা বেড়া দেওয়া গিরিমাটি লেপা মেটে ঘর নয়নদের। দূরে রাতের আলোয় দেখতে পায় ঘরের পাশে ঝোপড়া বুনো জাম গাছটার জমাটা বাঁধা অন্ধকার ঝুঁকে পড়েছে তাদের খাপরার চালে। এগিয়ে চলে নয়ন। কানে আসে ঘরের পাশের ডোবায় বুনো জামের পাতা পচা জলে একটানা ব্যাঙের ডাক।

ঘরের দাওয়ায় রাখা  কাঠের ডেঁড়কোয় রেড়ির তেলের কুপি। রাতের বাতাসে কাঁপা কাঁপা হলুদ আলো ছড়িয়ে আছে গোবর নিকনো ছিটা বেড়া ঘেরা ছোট্ট উঠানে। হ হ হ– কাশির দমক। বাপটার জন্য বুকটা মোচড় দেয় নয়নের। এবার মাসের ট্যাকা পেলে বাপটারে নিয়ে যেতে হবে বাগমুড়ির সরকারি হাসপাতালে।

দাওয়ার চালার নিচে, মাটি খোঁড়া চুলার খোঁদলে শুকনো ডালপালা গুঁজে দিচ্ছে  ফুলমনি। পাট কাঠির ফুঁ তে ঝলকে ওঠা লক লকে আগুনের শিখায় মা’র ঘামতেলা মুখ লালচে দেখায়। রাতপোকার দল কুপির আলোর চারপাশে গুনগুনায়। নয়নার দুখী হরিণ চোখ ভেসে ওঠে লক্ষ তারায় মোড়া রাতের আকাশে। নয়ন দাওয়ার অপর দিকের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বাঁশী তে সুর তোলে –  

“একটু ঠিকর করে লাচরে ভাবের মার‌্যানী,
একটু গিদার করে লাচরে ভাবের মাল্যানী।
তোকে আম বাগানের আম খাওয়াবো এখুনি
তোকে জাম বাগানের জাম খাওয়াবো এখুনি।“ 

রাতের কালো নিথর আকাশে ভেসে বেড়ায় আড় বাঁশীর মিঠে সুর।

গাঁয়ের মাঝির মেয়ের বাপলা বিয়ের আসরে শোনা গানগুলি  নয়নের মনে গেঁথে আছে। নিজের মনে গানের কথা উল্টেপাল্টে নিজের সুরে  বাঁশী বাজায় নয়ন। শোনে তার মা ফুলমনি আর শোনে নয়না যখন তারা সাতগুরুঙের ধারে গাই বকনা চরাতে যায়।

গাঁ’য়ের ওপারে ভুট্টার ক্ষেতি থেকে হঠাৎ ভেসে আসে একটানা মাদলের শব্দ সাথে হরেক স্বরে হো হো হো আওয়াজ। মশালের আলোয় ওদিকের এক ফালি আকাশ আগুন রাঙা। আজ হাতি ঢুকেছে বোধহয়। কাল নয়নের পাহারা দেওয়ার পালা। পাহারায় গেলে রেতে ভাত জোটে না।  তবে নতুন কিছুর স্বাদ চিনিয়েছে পাশের দুয়ারসিনি গাঁয়ের পালান কিস্কু। ওদের গাঁয়ের আশপাশের বন জঙ্গলে শহর বাবুরা ঘুরতে আসে। বন বাবুরা পালানকে শহর বাবুদের বনজঙ্গল ঘোরানোর কাজে লাগিয়েছে। সে শহরবাবুদের জঙ্গল চেনায় আর নিজে শেখে অন্যকিছু। রেত পাহারায় পালান গামছায় বেঁধে নিয়ে আসে লম্বা বোতলে ভাত পচাই। লুকিয়ে রাখে ক্ষেতি পাহারার মাচার নিচে। পাহারা দলের গাঁ বুঢ়ারা রেতের দিকে ঝিমোতে থাকে, কারুর হাতে শাল পাতার চুট্টার আগুন বিন্দু ধিকি ধিকি জ্বলে। সে নয়নকে মাচার নিচে নিয়ে এসে হাতে তুলে দেয় পচাই এর বোতল। নয়ন এখন বোঝে ভাত পচাই প্যাটের খিদে মেটায় আবার নেশাও ধরায়। পালান বলে –

“তুকে  লিয়ে যাব’রে লয়ন বনবাবুর কাছে। জঙ্গলের গাছে গাছে লম্বর দাগাতে হবে। মাসকাবারি মজুরী পাবি বটেক আর উপরিও আছে’রে লয়ন। শহরবাবু গুলানের হাতে গজ্গজ করে ট্যাকা । হুই তো সেদিন এক বাবু  বলে এক বোতল ভাত পচাই লিয়ে আয়। ঘরে ছিল বাপের এক বোতল, মুর মাতা খারাপ হলোরে লয়ন – বাবুটা মোরে দিয়ে দিল কর্ করে এক পচাশ ট্যাকার লোট !“

হা হা হাসে পালান পচাই এর নেশায়।

চুলায় উথলে ওঠা গরম মেঠে  লাল ভাতের সোঁদা মাটির গন্ধে প্যাটের খিদে চনমনায়। নাদা ভরে মেঠে ভাত, কুচো মাছের লঙ্কা হলুদের ঝোল আর আলু সানায় দিন শেষের খিদে মেটায় নয়ন। রাত পাখির ডাক রাতটারে করে তোলে গভীর –

নয়নার চোখ দুটো ভাসে তারার আলোয়, ঘরের দাওয়া এসে তুলে নেয় তার আড় বাঁশী, সুর ওঠে  –

“জংলি মোরগ ডেকেছে দূর নীল পাহাড়ে
ডুংরীর ধারে গভীর বনে কেকাধ্বনি

মৌউলি বনে খরগোশ, ঠেলুর তেড়াহুড়ি

শিকার হবে, শিকার হবে,
আসনপানি কাঁপছে যেন ঢেঁকির পাড়
রেগড়া টামাক বাজে
কেন বাজ কেন বাজে—–“

নয়ন দাওয়ায় বসে ভাবে পরের বোশেখী পূর্ণিমায় সে যাবে দিসুম সেঁদরা পরবে। বাপের বেতের ধনু আর মরচে ধরা তির  নিয়ে দলের সঙ্গে যাবে শিকার লাচে।

বনমোরগ, খরগোশ শিকারেই নয়ন মরদ হবে। টুসুর মেলায় সেও যাবে কনের খোঁজে। সাজো মাটি ঘসা চুলে  জড়ানো পলাশ, গলায় পলাশ বীজের মালা, নয়না কে বেছে নেবে নয়ন। যোগমাঝি পাকা করবে তাদের বাপলা বিয়ে।

দাওয়ায় বসে দেখা যায় বুনো জামের ঝুপসী অন্ধকারের ওপরে  তারায় ভরা মখমলি আকাশ, ডোবার জামপাতা পচা জলে একটানা ব্যাঙের ডাক, দূরের আকাশে ক্ষেতি পাহারের মশালের আলো, ঘরের ভেতরে  বাপের মাঝে মাঝে দমকা কাশির হ হ হ।

আকাশে  একটুকরো পেঁজা তুলোর মেঘে নয়ন  ভাসিয়ে দেয় তার বাঁশীর সুর। পেঁজা মেঘের সাথে রাতের আঁধারে নয়নের সুর ভেসে যাবে মেঘদহ গাঁয়ে ঘুমিয়ে থাকা নয়নার স্বপ্নে –

রাত আরো গভীর হয়। পালান কিস্কু স্বপ্ন ধরিয়েছে নয়নের মনে। নয়নার লজ্জানত হরিণ চোখ ভাসে রাতের আলোয়।  মনে ভাসে আসানপানির হাড়াম মাঝির বাপলা বিয়ার মন্ত্র –

“আজ থেকে তুরে  দিয়া হল নয়নার ভার।

শিকারে গেলে তুই খাবি অর্ধেক ও ঘরে আনবি অর্ধেক ।

রোগে শোকে, সুখে দুখে তুরা সঙ্গী সাথী হয়ে থাকবি।

আজ লয়নার পেরান  মন সবই তুরে দিয়া হল। “

খুশির রেশ মাখা  ঘুমে জড়িয়ে আসে নয়নের চোখ।

= ===========

Please Check my Website : www.sanjibchakraborty.in

-Advertisement-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here