-Advertisement-

রক্তরাগ

কর্ম উপলক্ষে কোলকাতার কাছেই গঙ্গার  ধারের কোনো  আধা শহরে কিছুদিনের জন্য এসেছি। অতীতের অনামা গ্রামটি এখন ধীরে ধীরে পরিবর্ত্ত হচ্ছে মফস্বল শহরে। হোটেলের অভাব, উঠেছি কর্মসূত্রে পরিচিত জনের ব্যবস্থা করা শহরের উপকন্ঠে একটি  বাড়িতে। দিনান্তে কাজের শেষে ঘুরে বেড়াই আধা শহরটির আসপাশ।

সেই সময় শহরের উপকণ্ঠে গ্রাম্য পরিবেশে, এক চা’র দোকানীর কাছে গ্রামের নিকটে জঙ্গলের মধ্যে প্রাচীন মা ভবানীর মন্দির আর  সেই সম্পর্কিত চাপা গুজবের গল্প শুনে কৌতুহলি হয়ে পড়ি। 

সেই সময় শহরের উপকণ্ঠে গ্রাম্য পরিবেশে, এক চা’র দোকানীর কাছে গ্রামের নিকটে জঙ্গলের মধ্যে প্রাচীন মা ভবানীর মন্দির আর  সেই সম্পর্কিত চাপা গুজবের গল্প শুনে কৌতুহলি হয়ে পড়ি। ।

এই শতাব্দী প্রাচীন মা ভবানীর মন্দিরটি নাকি মারাঠা বর্গী ভাস্কর পন্ডিতের দল ছুট সৈন্যরা প্রতিষ্ঠা করেছিল। মন্দিরটি রক্ষণাবেক্ষণ আর প্রতি সপ্তাহে শনি আর মঙ্গলবার পুজার জন্য নিযুক্ত আছেন এক বৃদ্ধ পুরোহিত। মন্দিরের প্রায় আধা মাইল বৃত্তের বাইরে চাষ আবাদের জমি। জমিতে কাজ করা মানুষ জনেরা পারতপক্ষে জায়গাটা এড়িয়ে চলে। কারণটা দোকানী ভদ্রলোকের কাছে অজানা ।

 সারা দিন কাজের মধ্যে  মন্দির সম্পর্কিত গুজব মনের মধ্যে ঘুরপাক খায়। কৌতুহল দানা বাঁধতে থাকে । পরের শনিবার  দুপুরে কাজের পর , হাঁটা দিলাম মন্দিরের দিকে। শহর ছাড়িয়ে গঙ্গার তীর ধরে প্রায় মাইল দেড়েক হেঁটে, বিকেলের দিকে পৌঁছলাম জায়গাটায়।

সারা দিন কাজের মধ্যে  মন্দির সম্পর্কিত গুজব মনের মধ্যে ঘুরপাক খায়। কৌতুহল দানা বাঁধতে থাকে । পরের শনিবার  দুপুরে কাজের পর , হাঁটা দিলাম মন্দিরের দিকে। শহর ছাড়িয়ে গঙ্গার তীর ধরে প্রায় মাইল দেড়েক হেঁটে, বিকেলের দিকে পৌঁছলাম জায়গাটায়। গঙ্গা গর্ভে প্রায় নিমজ্জিত লাল পাতলা ইঁটের

ঘর বাড়ির ধ্বংসাবশেষ নজরে আসে । চারিদিক শুনসান, নদী তীর  নিঝুম নিশ্চূপ, ভাটায় জেগে ওঠা  চর থেকে ভেসে আসা পাখির ডাক নিঝুম অপরাহ্নের স্তব্ধতায় আলোড়ন তোলে। কিছুটা এগিয়ে, গাছপালার আড়ালে একচালা মন্দিরের অংশ বিশেষ নদী তীর থেকে নজরে আসে । চারিদিকে চোখ রেখে ঘন পলাশ,শিমুল, পিপুল, বটের  জটলার ভেতর দিয়ে ধীরে ধীরে মন্দিরের দিকে এগোই । কারুকার্য হীন সাদামাটা  লাল মাটির অতি সাধারণ একচালা স্থাপত্য। সায়াহ্নের অস্তগামী সূর্যের সমান্তরাল গৈরিক ছটা  গাছগাছালির ঘন সন্নিবদ্ধ পাতা চুঁইয়ে চিত্রবিচিত্র করছে লাল মাটির মন্দিরের বহির্গাত্র।  জন বিরল ঘন গাছাপালার আড়ালে এত বছর পরেও অটুট বর্গীদের মা ভবানীর  আবাস। প্রায় শ ‘দুই গজ দুরে গাছপালার জটলার বাইরে মন্দিরের উল্টো দিকে সবুজ ঘাসে ভরা ছোট চত্বরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে অতি প্রাচীন নিম গাছ, নিচে সিমেন্টের ভাঙ্গাচোরা বসার জায়গা।

অনাবৃত উর্দ্ধাঙ্গে পৈতে, মলিন ধুতি পরিহিত শীর্নকায় এক বৃদ্ধ তখন মন্দিরের সাধারন লোহার গ্রীলের দরজা বন্ধ করছেন। মনে হয় ইনিই মন্দিরের পুরোহিত। দ্রুত পায়ে  মন্দিরের কাছে পৌঁছে  ভেতর  উঁকি দিয়ে দেখি ঝকঝকে পিতলের পিলসুজের আলোর স্বল্পতায় আলোআঁধারি, দেওয়ালের গায়ে  পোড়া মাটির মূর্তির আভাস। বছরের পর বছর তেল সিঁদুরের প্রলেপে মূর্তির আকৃতি পুরোপুরি পরিস্কার নয়। বৃদ্ধ মন্দিরের দরজা বন্ধ করে, আমার দিকে একবার তাকিয়ে, হাঁটা দিলেন ঘন গাছগাছালির মধ্য দিয়ে পায়ে পায়ে তৈরি  সরু পথ ধরে শহরের দিকে। বাসায় ফেরা শ্রান্ত পাখিদের ডানা ঝাপটানোর সাথে অবিশ্রান্ত কলকুজনে জঙ্গলের নিস্তব্ধতায় সাময়িক ছেদ পড়েছে । তাড়াতাড়ি এগিয়ে ওনার সাথে পায়ে পা মিলিয়ে চলার সময় জিজ্ঞাসা করি উনিই মন্দিরের পুরোহিত কিনা।  সম্মতি সূচক মাথা হেলিয়ে এগিয়ে চলেন ঋজু পদক্ষেপে । চুপচাপ পাশাপাশি হেঁটে জঙ্গল পেরিয়ে কিছুটা এগিয়ে পৌঁছলাম শহরের উপকণ্ঠে পরিচিত চা’র দোকানটি তে। আমার চা খাওয়ার অনুরোধে রাজি হলেন। ভদ্রলোককে হ্যাজাকের আলোতে ভালো করে লক্ষ্য করি। 

পাঁশুটে অবিন্যস্ত চুল কাঁধ ছুঁয়েছে, বেশ কয়েক দিনের না কামানো দাড়ি,, বয়স সত্তরের উপরই মনে হয় অন্যমনস্কতায় আচ্ছন্ন উদ্দেশ্য বিহীন চোখ,হ্যাজাকের আলোর বৃত্তের বাইরের অন্ধকারে  নিবদ্ধ 

পাঁশুটে অবিন্যস্ত চুল কাঁধ ছুঁয়েছে, বেশ কয়েক দিনের না কামানো দাড়ি,, বয়স সত্তরের উপরই মনে হয়। অন্যমনস্কতায় আচ্ছন্ন উদ্দেশ্য বিহীন চোখ,হ্যাজাকের আলোর বৃত্তের বাইরের অন্ধকারে  নিবদ্ধ।  সাধারন কথাবার্তায় ওনার নাম জানলাম শ্রীনিবাস বন্দোপাধ্যায়, একাই থাকেন শহরের গা ঘেঁসা এই আধা গ্রাম্য জায়গাটিতে। মন্দিরের দেখাশোনা আর সপ্তাহে দু দিন পুজো ছাড়া আর কোনো কাজ নেই। কথায় কথায় জানলাম, বর্তমানে যাঁর বাড়িতে  আমার সাময়িক আস্তানা, তিনি শ্রীনিবাস বাবুর পরিচিত। বললাম আগামীকাল রবিবার, দিনের বেলা মন্দিরটা ভালো করে দেখার ইচ্ছে আছে, তারপর  অনুমতি দিলে , ওনার সাথে একবার দেখা করতে পারি কি না। জিজ্ঞাসু  দৃষ্টিতে  তাকিয়ে মাথা হেলিয়ে, বাড়ির পথ নির্দেশ দিয়ে বলেন কাল সকাল ন’টায় বাড়ি থাকবেন। নমস্কারন্তে নিজের আস্তানার পথ ধরলাম।

পর দিন ভোরে নদীর ধারে এসে দাঁড়াই। নদী গর্ভে নিমজ্জমান ভগ্নাবশেষের বর্তমান অবস্থান ইঙ্গিত করে অতীতে নদীর  ভয়ঙ্করী  আগ্রাসন প্রবণতার । স্থানে স্থানে জলস্তরের উপরে জেগে রয়েছে পাতলা লাল ইঁটের গাঁথুনির ভগ্নস্তুপ, বহুকাল আগে নদী খাত ধিরে ধিরে  প্রসারিত হয়ে তীর সংলগ্ন বসতি গ্রাস করার সাক্ষি হয়ে। চারপাশ ঘুরে মন্দিরের লোহার গ্রিলের বন্ধ দরজার সামনে আসি, ভিতরে দিনের আলো আসার পথ নেই, পিলসুজের প্রদীপ বোধহয় রাতেই নিবে গেছে। ভেতরের দেওয়ালে পোড়া মাটির লেপনে দেবী আকৃতি  সেই আলোআঁধারিতেই রয়ে গেছে । চারিদিক শুনসান, শুধু বহু কালের সাক্ষী  ঘন জঙ্গল ঘেরা এই চুন সুরকি ও লাল মাটির অতি সাধারন স্থাপত্যের মন্দিরটি এখনো অটুট, প্রাচীনতার নজীর বিশাল নিম গাছ  আর জনহীন নিঝুম পরিবেশ ছাড়া আর কিছু নজরে আসে না।   বিশাল নিম গাছের নিচে বসে,

আমাদের বাংলা দেশের  ছোট্ট একটি  অকিঞ্চন বোবা ইতিহাসের কথা ভাবি যা কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে

আমাদের বাংলা দেশের  ছোট্ট একটি  অকিঞ্চন বোবা ইতিহাসের কথা ভাবি যা কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে।

ঘড়ির কাঁটা আটটা ছুঁই ছুই। কল্পভাবনার জাল কেটে তড়িঘড়ি হাঁটা দিলাম শ্রীনিবাস বাবুর বাড়ির সন্ধানে। গ্রাম্য জায়গাটায় পৌঁছে, স্থানীয়দের জিজ্ঞাসা করে পৌঁছলাম পলস্তারাহীন টিনের ছাদের বাড়িতে। সামনে অল্পকিছু খালি জমির আনাচকানাচে অযত্নে বেড়ে ওঠা নয়নতারার ঝোপ। দরজার কড়া দড়ি দিয়ে বাঁধা। একটু  অপেক্ষার পর শুনি এসে গেছেন ! শ্রীনিবাস বাবু এক বালতি ভরা জল নিয়ে দাঁড়িয়ে। বলেন পাশেই সরকারি টিউবওয়েল থেকে খাওয়ার জল নিতে গেছিলেন। ভেতরে এসে দুটি ঘরের একটিতে আমাকে বসিয়ে, কিছুক্ষণ পর দু গ্লাস চা হাতে ফিরে এলেন। অভ্যসগত অন্যমনস্ক দৃষ্টি দরজার বাইরে ভাসিয়ে আমার আসার কারণ জিজ্ঞাসা করলে, ধিরে ধিরে আসার উদ্দেশ্য ব্যক্ত করে  জানাই তাঁর দীর্ঘকাল ভবানী মন্দিরটির সাথে জড়িত থাকার অভিজ্ঞতার সুবাদে স্থানীয় জনশ্রুতির রহস্যের ওপর যদি তিনি আলোক পাত করেন । আপনার হঠাৎ ওই মন্দির সম্পর্কে কৌতুহলের কারণ? বাইরে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে প্রশ্ন করেন। বলি ইতিহাসবিদ না হলেও আমাদের দেশে নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা  অখ্যাত সৌধ ও তার সাথে জড়িত জনপ্রবাদ আমাকে কৌতুহলি করে তোলে, এ ছাড়া আর কোনো উদ্দেশ্য নেই। কিছুক্ষন চুপ করে থেকে, খালি গ্লাস দুটো নিয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে গিয়ে, একটু পরেই ফিরে এসে বলেন ওই মন্দিরের সাথে আমার উর্দ্ধতন বহু পুরুষের আত্মার টান জড়িয়ে আছে । বহুকাল কখনো কেউই অনুসন্ধিতসা প্রকাশ করেনি। আমার শেষ কাল উপস্থিত।  আপনি অমুক বাবুর পরিচিত বলেই আপনাকে মন্দিরের ইতিহাস যতটা জানি বলবো। ঘরের মেজেতে পাতা শতছিন্ন বিছানায় যুত হয়ে বসে, বলতে লাগলেন।

শ্রীনিবাস বাবুর বলা ইতিহাস, নিচে সাজিয়ে দিলাম।

“”আমি পিতৃহীন হই খুব ছোটো বয়সে, বড় হয়েছি পিতামহের কাছে। এখন যা বলছি, পিতামহেরর কাছে শোনা, তিনি শুনেছিলেন তাঁর পিতা, পিতামহের কাছে। এই ভাবে বংশ পরম্পরায় প্রচলিত হয়ে আসছে এই কাহিনী। কথিত আছে অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়, মারাঠি বর্গী নেতার মৃত্যুর পর  ছত্রভঙ্গ বর্গীর দল নানা অংশে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে । সে সময় এই পুরো অঞ্চল ছিল ঘন জঙ্গল অধুস্যিত। মুঘল সেনাদের ভয়ে, বর্গীদের একটি দল এই অঞ্চলে পালিয়ে এসে ধিরে ধিরে বসতি  গড়ে তোলে নদীর ধারে। উদ্দেশ্য ছিল জল পথে কোনো একদিন নিজেদের দেশে প্রত্যাবর্তনের,কারণ ছিল বোধহয় স্থল পথে মুঘল শক্তির উপস্থিতি। আন্দাজ সেই অশান্ত সময় বর্গীরা তখনকার গভীর জঙ্গলে প্রতিষ্ঠা  করে তাদের আরাধ্য মা ভবানীর তাল পাতায় ছাওয়া একচালা মন্দির। হানাদারির পূর্বে মশালের আলোয় মন্দিরের দেবীর সাথে পূজিত হত  তাঁর পাদপদ্মে স্তুপকৃত তেল সিঁদুর লিপ্ত অস্ত্রসকল। তারা লুটতরাজের ধনদৌলত জমা করতো নদীর ধারের ওই মন্দিরের কাছে।

দুর্দান্ত বর্গীদের কোনো নেতা ভাগ্যের খেয়ালে নিজের দেশে আর ফিরতে পারে না। কোনো এক বিশেষ ঘটনায় তার চরিত্রের আমূল পরিবর্তন হয়ে দস্যুবৃত্তি ছেড়ে দখলিকৃত জমি আবাদে জমিদারি পত্তন করে । ক্রমশ  তাঁর বংশ স্থানীয় সমাজ জীবনের সাথে মিশে যায়। তাঁর পরিচয় অনুক্তই থাক।  এরপর এই বংশের বহু যুগের উত্থান পতন, মহাকালের  গর্ভে তলিয়ে গেছে । অনেক কাল পরে, তখন মন্দিরের বর্তমান স্থল, ঘন জঙ্গলের ভেতর দাঁড়িয়ে ছিল শুধু আদি মন্দিরের পিছনের মূল দেওয়ালটি, যার গায়ে পোড়া মাটিতে খোদিত মা ভবানীর  প্রায় অক্ষত আকৃতি। এদেরই এক উত্তরপুরুষের উদ্যোগে সেই মূল দেওয়ালে খোদিত দেবী  আকৃতির আদিত্ব বজায় রেখে  গড়া হয় বর্তমান মন্দিরটি । মা ভবানীর পুজায় মাসোহারা ভিত্তিতে নিযুক্ত হন এক গৌড়ীয় নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ । 

  সেই সময়ের থেকে প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী ওই ব্রাহ্মণ বংশের  একমাত্র জ্যেষ্ঠ পুত্ররাই নিযুক্ত হয় এই মন্দিরে পুজার পুরোহিত হিসাবে আর আমি সেই বংশের সপ্তম এবং শেষ জীবিত পুরুষ

সেই সময়ের থেকে প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী ওই ব্রাহ্মণ বংশের  একমাত্র জ্যেষ্ঠ পুত্ররাই নিযুক্ত হয় এই মন্দিরে পুজার পুরোহিত হিসাবে আর আমি সেই বংশের সপ্তম এবং শেষ জীবিত পুরুষ। মাসোহারার সমাপ্তি হয়েছে জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির সাথে সাথে। বর্তমানে বেঁচে আছি পুর নিগমের সামান্য অনুদানের উপর নির্ভর করে। এই হলো মন্দিরের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।“”

শ্রীনিবাস বাবু ঘড়ি দেখে বলেন অনেকটা সময় বয়ে গেল। আমার এখানেই দু ‘জনের ভাত ডাল হয়ে যাবে। বাধা দেওয়ার আগেই ,আসছি বলে বেরিয়ে যান। কিছুক্ষণ পরে এসে বলেন দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থা করা গেছে। একটু হেসে  কথার খেই ধরেন এবার আসি স্থানীয় লোক মুখে পল্লবিত হওয়া গুজবে,আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতায় যার কিছুটা অংশ হয়ত সত্য।’   

“”দুর্দমনীয় মারাঠা দলছুট অশ্বারোহনে পারদর্শী  দস্যুর দল ,নদীর ধারে বসতি করে প্রাথমিক লোক দেখানো জীবিকানির্বাহের উপায় হিসেবে নিজেদের নিযুক্ত করে মাছ ধরা ও কৃষি কার্যে। ক্রমশ তাদের চারিত্রিক নৃশংসতার  বহিঃপ্রকাশ সন্ত্রস্ত করেতে থাকে স্থানীয় বিশাল তল্লাট জুড়ে । দেখা যায় প্রতি অমাবস্যা রাত্রের দ্বিতীয় প্রহর থেকে ত্রিশ চল্লিশ মাইলের মধ্যে জমিদার ও অবস্থাপন্ন গৃহস্থের ঘরে ঘরে তাদের হানাদারি, সাধারন গৃহস্থ নারী লুন্ঠন, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদিতে, অঞ্চলের বাসিন্দাদের অতিষ্ঠ করে তোলে । আবার পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষ ভাবাপন্ন ধনী জমিদার ও গৃহস্থরাও অশ্বারোহি দস্যুদের অর্থের বিনিময়ে নিয়োজিত করতে থাকে নিজেদের স্বার্থোদ্ধারে। অরাজকতায় দেশ ভরে গেল। “”

আসুন দুপুরের  খাওয়া দাওয়াটা সেরে নেওয়ার পর শুরু করা যাবে গুজবের মূল উৎস। কিছু পরে শ্রীনিবাস বাবু নিজস্ব ভাষায় আরম্ভ করেন।

সেদিন ছিল ভাদ্রপদা অমানিসির রাত ঘন কালো কেশদাম সদৃশ আকাশের চুঁইয়ে পড়া নিবিড় তমসায় সুপ্ত প্রকৃতি দ্বিতীয় প্রহরের প্রারম্ভে দুরে দুরের ছড়িয়ে থাকা গ্রাম গুলির কিছু কিছু  গৃহস্থ বাড়ির পিদিমের নিভন্ত আলো, যেন দুর মহাশূন্য হতে খসে পড়া তারা রা চোখের পলক ফেলে

“”সেদিন ছিল ভাদ্রপদা অমানিসির রাত। ঘন কালো কেশদাম সদৃশ আকাশের চুঁইয়ে পড়া নিবিড় তমসায় সুপ্ত প্রকৃতি। দ্বিতীয় প্রহরের প্রারম্ভে দুরে দুরের ছড়িয়ে থাকা গ্রাম গুলির কিছু কিছু  গৃহস্থ বাড়ির পিদিমের নিভন্ত আলো, যেন দুর মহাশূন্য হতে খসে পড়া তারা রা চোখের পলক ফেলে।

দশ মাইল দুরের বর্ধিষ্ণু গ্রামের জমিদার অমুক বাবুর বাড়ির গৃহদেবতার পূজা শেষে সবাই যে যার ঘরে ঘুমে অচেতন ।  জমিদার আর দেবীরুপা  আলুলায়িত ঘন কেশদাম, লাল চেলি পরিহিতা ক্লান্ত গৃহকর্ত্রী পূজোর ও ঘরের কাজ শেষে নিদ্রারতা ।  কিছু সংখ্যক লাঠিয়াল ঘুমন্ত  জমীদার বাড়ি পাহারায় নিযুক্ত। 

সেই ক্ষনে জঙ্গলের ভেতর, তালপাতায় ছাওয়া মন্দিরে দুটি মশালের আলোয় আলোকিত মহাদেবী মা ভবানী পুজো শেষ করে বর্গী সর্দার। পুজার পর তার দলবল, যে যার অস্ত্র হাতে , জলন্ত মশালে বনের পথ  আলোকিত করে, জয় মা ভবানী উচ্চ রবে ও দ্রুতগামী ঘোড়ার ক্ষুরের আওয়াজে  রাতের আকাশ বাতাস মথিত করে রওনা দিল মাইল দশেক দুরের অমুক জমিদার বাড়ির উদ্দেশ্যে। পথ ধারের ঘুমন্ত গ্রাম গুলির নিদ্রাছন্ন গৃহস্থ  ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দে সচকিত হয়ে দুর্গা নাম জপে।

জমিদার বাড়ির চৌহদ্দিতে পৌঁছে ভয়াল  জয় মা ভবানী রবে  শুরু হয় বর্গীদের উন্মত্ততা। অমাবস্যা রাতে রক্তের হোলি খেলা। অপ্রস্তুত লাঠিয়ালদের ধরাশায়ী রক্তাক্ত দেহগুলি পার হয়ে, সদর দরজা ভেঙ্গে শুরু হয়  লুটতরাজ। বর্গীদের সর্দার সবার শেষে, লুটতরাজ, রক্তপাতের নেশায় উন্মত্ত সঙ্গীদের পাশ কাটিয়ে ধনরত্নের সিন্দুকের খোঁজে পৌঁছায়  জমিদারের শয়ন কক্ষে। লাঠি হাতে রুখে দাঁড়ান সদ্য ঘুম ভাঙা জমিদার,পাশে পুজার রক্ত চেলি পরিহিতা আগুন ঝরা রক্তপলাশ  চোখে  গৃহকর্ত্রীর রণ মূর্তি। মশালের আলোতে সেই মূর্তি সর্দারের চোখে জাগায় বিভ্রম। পর মূহুর্তে সর্দারের বাঁকানো খড়গের আঘাতে লুটিয়ে পড়েন জমিদার। গৃহকর্ত্রীর করুণ আর্তনাদ অনুরণিত হতে থাকে জমিদার বাড়ির আনাচ কানাচ,সর্বত্র। তিনি রক্ত স্রোতে ডোবা, জমিদারের ক্ষতবিক্ষত শরীরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁকে রক্ষার উদ্দেশ্যে। ধনরত্ন লুটের পর, মশালের আলোয় দস্যু লক্ষ্য করে, জমিদারের রক্তে ভেজা শরীরের ওপর পড়ে আছেন অচেতন গৃহকর্ত্রী, রক্তে ভেজা আলুলায়িত ঘন কুঞ্চিত কেশদামের আচ্ছাদনে ঢাকা পড়েছে তাঁর পৃষ্ঠদেশ। আদিম লিপ্সায় কয়েক লহমা দ্বিধাগ্রস্ত সর্দার কাঁধে  তুলে নিল অচেতন গৃহকর্ত্রীর নিস্পন্দ দেহ।  তখনো জমিদার বাড়ি লুটে মত্ত সাগরেদদের পাশ কাটিয়ে ঘোড়ার পিঠে গৃহকর্ত্রীর অচেতন দেহ তুলে, দস্যুপতি জোর কদমে ঘোড়া ছোটায় জঙ্গলের ডেরার দিকে। তাদের নিয়ম অনুযায়ী, সর্বাগ্রে মা ভবানীর পায়ে লুটের সামগ্রী উৎসর্গ করতে হবে।

 দেবী আকৃতির দু পাশে প্রজ্জলিত দুটি মশালে আলোকিত মন্দির অভ্যন্তর, দেবীর অস্ত্র বাঁকানো খড়্গ, মারাঠি বরিচা বা বর্শার ঝকঝকে ইস্পাত ফলা যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে ।  লুন্ঠিত নারী, ধন সামগ্রী দেবীর পাদদেশে সমর্পিত  করে বর্গী সর্দার মন্দিরের বাইরে অপেক্ষা করে সঙ্গীসাথীর। দুর থেকে তাদের মত্ত হুঙ্কার ও ছুটন্ত ঘোড়ার ক্ষুরের  শব্দ এগিয়ে আসে। সর্দার বিস্মায়িত দৃষ্টি লক্ষ্য করে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠছে মন্দির অভ্যন্তরের মশাল । মেঘহীন মিশকালো আকাশে হঠাত্ই বিদ্যুতের ঝলক। দমকা বাতাসের বেগে তুফানের অনুভূতি। সর্দারের হাতে ধরা মশালের কাঁপা আলোয় দেখা যায় জঙ্গলের শুকনো ধুলা, ঝরা পাতার ঘূর্ণাবর্ত । কোনো শব্দে সর্দার পিছু ফেরে। দেখে, দমকা বাতাসে প্রবল ভাবে আন্দোলিত মন্দিরের তালপাতার একচালা বাতা। মন্দিরভ্যন্তরের  মশালের অস্বাভাবিক উজ্জলতা পিছনে রেখে এগিয়ে আসছে  টল টলায়মান নারী দেহের অশরীরী প্রতিচ্ছায়া। আচমকা দমকা হাওয়ায় সর্দার হাতের  মশালের  আন্দোলিত আলোয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে জ্ঞান ফিরে পাওয়া জমিদার গৃহকর্ত্রীর মূর্তি, হাতে মা ভবানীর অস্ত্র বরিচা বা বর্শা,অন্য হাতে মন্দিরের মশাল। সিঁথির ঘামে ভেজা  সিঁদুরে জমিদারের রক্তের মিশেল নানা ধারায় ছড়িয়ে পড়ে কপাল থেকে চিবুকে। হাওয়ায় ওড়ে রক্তে ভেজা আলুলায়িত কেশরাশি, লাল চেলির দেহাবরন । ঝোড়ো বাতাসে কোথা থেকে ভেসে আসে গম্ভীর ঘণ্টা ধ্বনি।  ক্ষনে ক্ষনে বৃদ্ধি পায় মেঘহীন মিশকালো আকাশে বিদ্যুতের ঝলক, ভয়বিহ্বল সর্দারের কল্পনার চোখে সেই নারী মূর্তি হয়ে ওঠে মা ভবানীর প্রতিকৃতি। দেবীর অস্ত্র হাতে নারী মূর্তি এগিয়ে আসে সর্দারের দিকে, রক্তে ভেজা আয়ত পলাশ চোখের শীতল দৃষ্টিতে সর্দারের অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে  । স্খলিত শরীর দুর্দম দস্যুর হাতের অস্ত্র খসে পড়ে, অজান্তে যুক্তকরে নতজানু হয়। নারী মূর্তির কন্ঠ থেকে রাগ, যন্ত্রনা হতাশা মিশ্রিত শরীর নিংড়ে বেরিয়ে আসে এক অতি তীক্ষ্ণ হাহাকার ধ্বনি, তার প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে পড়ে আকাশে বাতাসে, জঙ্গলের গাছের পাতায় পাতায়, মিশে যায় গম্ভীর অতিপ্রাকৃতিক ঘণ্টা ধ্বনির সাথে। পর মুহূর্তে, বাতাসের বেগ আরো বৃদ্ধি পায়, চক্রাকারে উপরে ওঠে ধুলো, শুকনো পাতা। মন্দিরের দাহ্য কাঠামো, তালপাতার ছাউনিতে ছড়িয়ে পড়ে আগুনের  আকাশ ছোঁয়া লেলিহান শিখা সাথে উচ্চ ঘণ্টা ধ্বনিতে উদ্দাম হয়ে ওঠে পটভূমি।

নারী রণ মূর্তি স্থির হন  সর্দারের সামনে তিনি ঝুঁকে পড়েন হাতের বর্শার আলো বিচ্ছুরিত ইস্পাত ফলার ওপর, এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যায় নারী শরীর, রক্তের ফিনকি ধারা ভিজিয়ে দিল পায়ের নিচের মাটি, নতজানু সর্দারের দেহ

নারী রণ মূর্তি স্থির হন  সর্দারের সামনে। তিনি ঝুঁকে পড়েন হাতের বর্শার আলো বিচ্ছুরিত ইস্পাত ফলার ওপর, এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যায় নারী শরীর, রক্তের ফিনকি ধারা ভিজিয়ে দিল পায়ের নিচের মাটি, নতজানু সর্দারের দেহ।

মা ভবানীর মন্দির জ্বলে খাক হয়ে গেল। ধিরে, অতি ধিরে, যেন মন্ত্র বলে অতিপ্রাকৃতিক তাণ্ডবেরও পরিসমাপ্তি ঘটে। শুধু অক্ষত রয়ে গেল মন্দিরের চুন শুরকির দেওয়াল, তার গায়ে খোদিত পোড়া মাটির দেবী আকৃতি। এই হলো স্থানীয় জনশ্রুতির ভিত। সুদুর কোন কালে,কখনো কেউ  শুনেছিল কোন শব্দ বা দেখেছিল কিছু, যা যুগ যুগ ধরে পল্লবিত হয়েছে লোক মুখে।“”

শ্রীনিবাস বাবুর উদাস চোখের দৃষ্টি হারিয়ে যায় দরজার বাইরের ঘনায়মান সন্ধ্যায়। বলেন চা নিয়ে আসি।  মুহ্যমান আমি বসে থাকি একা। শ্রীনিবাস বাবু ফিরে এলেন। বলি পরশু মঙ্গল বার, মা ভবানীর পুজার দিন, অমাবস্যাও বটে। ওনার সাথে আমি যদি থাকি, আপত্তি আছে কি না। তাঁর উদাস চোখে দেখি অনুসন্ধিৎসার ঝিলিক কিন্তু  কিছু প্রকাশ না করে বলে ওঠেন না না আপত্তি হবে কেন, নিশ্চয় আসবেন, তবে ওই দিন অমাবস্যা, পুজা শেষ হতে দেরি হতে পারে। বাড়ি ফেরার পথে ভাবি, ওই দিন রাতে পুজার পর থেকেই যাব মন্দির চত্বরে। ভাগ্যে যদি থাকে, কিছু নতুন অভিজ্ঞতা হলেও হতে পারে।

পরের মঙ্গলবার যথাসময় পৌঁছে যাই শ্রীনিবাস বাবুর বাড়ি। কাঁধে ছিল একটি ঝোলা ব্যাগের ভেতর রুটি মাখন, জলের বোতল। ব্যাগের দিকে একবার তাকিয়ে শ্রীনিবাস বাবু চলতে থাকেন জঙ্গলের পথে। কিছু বাদে স্বভাবসিদ্ধ অন্যমনস্কতায়  বলতে থাকেন “” প্রকৃতির ভাঁড়ারে যুগযুগান্তর ধরে সুপ্ত হয়ে আছে নানা শব্দ, গন্ধ, ছবি, চলচ্চিত্র। যা চিরকাল স্থাবর ও জঙ্গম প্রাণের  আয়ত্তের  বাইরে থেকে গেছে। তবে স্থান মাহাত্মের কল্যাণে, কদাচিত মা প্রকৃতির বিচিত্র খেয়ালে কোনো  অতি ভাগ্যবানের দৃষ্টিতে,শ্রবনে বা ঘ্রাণে  চকিতের তরে সেগুলি প্রকাশ পেয়েই বিলীন হয়ে যায় মহাকালের গর্ভে, যা যথাযথ উপলদ্ধ হতেই কেটে যায় দ্রষ্টার জীবন। সুতরাং আপনার কোনো দুরাশার বাস্তবায়নের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।“” তাঁর কথায় অপরাধ বোধে আচ্ছন্ন হই, পূজারী বোধহয় আঁচ করেছেন আমার আজ রাতের উদ্দেশ্য। 

মন্দিরে পৌঁছে শ্রীনিবাস বাবু পূজার তোড়জোড় শুরু করে দিলেন । অস্তাচলের সূর্যরাগ গায় মাখছে, গাছগুলির ওপর স্তরের জড়াজড়ি করে থাকা পাতার দল। কিছু কিছু করে বাসায় ফেরে পাখিরা। সন্ধ্যাতারা উঁকি দেয় আকাশে। আঁধার নামার প্রস্তুতি শুরু করেছেন প্রকৃতি দেবী। মন্দির দ্বার প্রান্তে বসে দেখি পূজারম্ভের খুঁটিনাটিতে পুরোহিতের তন্ময়তা। গত শনিবার দেখেছিলাম, এই সময়ের মধ্যেই মন্দির দ্বার বন্ধ করেছিলেন শ্রীনিবাস বাবু। আজ পূজার আয়োজন যেন বড় বিস্তারিত। ধিরে ধিরে আঁধার নেমে আসে। কাঁপা কাঁপা পিলসুজের আলোয় মন্দিরাভ্যন্তরে অপার্থিবতার ছোঁয়া। দেওয়ালে খোদিত  পোড়া লাল দেবী আকৃতির অস্পষ্ট  দেহরেখা। মা ভবানীর সম্মুখে ধ্যানস্থ পুরোহিত। সময় পার হয়ে যায়। মন্দিরের বাইরে ঘাসের চত্বরে পায়চারি করার সময় অন্যমনস্ক দৃষ্টি স্থির হয়ে থাকে বহু যুগ আগের ঘটনার পটভূমিতে। কিছু পরে সম্বিত ফেরে গম্ভীর মন্ত্রোচ্চারণ ও ঘন্টাধ্বনিতে। অমানিশার আঁধার গাড় হয়ে উঠেছে ,নিঝুম

নিস্তব্ধতায় রাত জাগা পাখিরাও নিশ্চূপ, মাঝে মাঝে নদীর দিক থেকে বয়ে আসা হালকা বাতাসে প্রাচীন নিম গাছের পাতারা যেন শ্বাস নেয়। মন্ত্রোচ্চারণের গম্ভীর শব্দের ওঠানামায় নেশা ধরে। মন্দিরের খোলা দরজা দিয়ে পিলসুজের  অস্পষ্ট আলোর রেশ, নিম গাছের ঝুঁকে পড়া পাতায় কম্পিত হয়। নিকষ কালো অলৌকিক পরিবেশে নিজেকে হারিয়ে ফেলি।

অবশেষে পূজো শেষ হয়। দেবী সম্মুখে অর্ধ নিমীলিত চোখে শ্রীনিবাস বাবু এখনো সমাহিত। আলো আঁধারিতে হাতের ঘড়িতে চোখ পড়ে। ঘড়ি কাঁটা সাড়ে ন’টায় স্তব্ধ হয়ে আছে। সময় এখন অন্তহীন। অবশেষে শ্রীনিবাস বাবু তাঁর সামান্য কিছু জিনিষ গুছিয়ে আমাকে  ইঙ্গিত করেন নিম গাছের দিকে এগিয়ে যেতে। গাছের নিচে বাঁধানো বসার জায়গায় বসি। খেয়াল হয়, শুনেছিলাম, অমাবস্যা তিথির পুজার দিন  শ্রীনিবাস বাবুরর নির্জলা উপবাস। ব্যাগ থেকে জলের বোতল  এগিয়ে দিলাম। ইশারায় কথা বলতে নিষেধ করে চোখ বুঁজে তিনি পদ্মাসনে বসে থাকেন। পিলসুজের ম্রিয়মাণ আলোর রেখা মন্দিরের দরজা দিয়ে ঘাসের চত্বরে গা এলিয়ে  পড়েছে নিম গাছের নিচ অবধি। নদী থেকে বয়ে আসা বাতাসের আর স্পর্শ  পাচ্ছি না। দুজনে নিশ্চূপ বসে, রাত গভীর হতে থাকে।

কখন আধ ঘুমে ঢলে পড়েছি জানি না। হাতে মৃদু চাপ অনুভব করে চোখ মেলে দেখি শ্রীনিবাস বাবু ইঙ্গিত করছেন মন্দিরের দিকে। একি দৃশ্য, যেন কাঁপাকাঁপা জল স্তরের ভেতর দিয়ে দেখি মন্দির কে ঘিরেছে তেজহীন রক্তাভ অগ্নি বলয়ের আভাস। সে আলো ছড়িয়ে পড়েনি। চোখ ধাঁধায় না।

মনে হলো মন্দির চত্বরের ঘাস ছুঁয়ে এগিয়ে আসছে ভাসমান ছায়াময় নারী অবয়বের রূপরেখা। বহু দুরের থেকে ভেসে আসে ঘনঘন ক্ষীণ ঘন্টা ধ্বনি, ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ।

মনে হলো মন্দির চত্বরের ঘাস ছুঁয়ে এগিয়ে আসছে ভাসমান ছায়াময় নারী অবয়বের রূপরেখা বহু দুরের থেকে ভেসে আসে ঘনঘন ক্ষীণ ঘন্টা ধ্বনি, ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ

বাতাসহীন দম বন্ধ  পরিবেশ। শরীর মন কোনো যাদু কাঠির ছোঁয়ায় পাথর হয়ে গেছে। নিজস্ব চিন্তা ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি। আকাশে হঠাৎ বিদ্যুত চমক, অনুভব করি নারী কন্ঠের এক ঝলক তীক্ষ্ণ বুক চেরা তীব্র হাহাকার মিলিয়ে যায় ক্রম ম্রিয়মাণ অসহ্য পাথর চাপা গুমরানো কান্নায়। আপনা থেকে চোখ বন্ধ হয়ে আসে। কানের ভেতর ভেসে বেড়াতে থাকে দুর সমুদ্রের ঝোড়ো বাতাসের গর্জন। অসাড়তা গ্রাস করে মস্তিস্ক। চোখের সামনে এক হয়ে যায় নিকষ কালো আকাশ, পৃথিবী। আর কিছু মনে নেই।

চোখে মাথায় জলের ঝাপটায় চেতনা ফিরে আসে। শ্রীনিবাস বাবু জলের বোতল হাতে দাঁড়িয়ে। রাতের আকাশে  দিনারম্ভের লালের আভাস। চোখে মুখে শরীরে নদীর থেকে বয়ে আসা নরম ঠাণ্ডা বাতাসের পরশ। চোখ চলে যায় মন্দিরের দিকে। ওই তো, অল্প কদিনের পরিচিত মা ভবানীর মন্দির সেই একই ভাবে দাঁড়িয়ে। শ্রীনিবাস বাবু স্মিত হেসে বলেন চলুন, ভোর হয়েছে। মন গত রাতের ইতিমধ্যে ঝাপসা হতে থাকা স্মৃতিতে বিভোর, অসংলগ্ন পায়ে, নিশ্চূপ গম্ভীর শ্রীনিবাস বাবুর সাথে এগিয়ে চলি আধা শহরের পথে।

-Advertisement-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here