হাওয়াই যাবার প্ল্যান টা অনেক দিন ধরেই আমার মাথায় ছিল্। কিন্তু সময়াভাবে বা পর্যাপ্ত ছুটি না থাকার জন্য যাওয়া আর হয়ে ওঠেনি। আমেরিকাতে বেশীর ভাগ ভারত বাসীদের বেড়াতে যাবার প্রথম চয়েস হল “ভারতবর্ষ”। বেশীর ভাগ ভারতবাসীই দুতিন বছর ছুটি জমিযে এক বার করে “ইন্ডিয়া” ঘুরে আসে। আমাদেরও তাই হয় | তবে এবার আমরা ঠিক করেছিলাম হাওয়াই যাব ! সময়টা হলো ২০১৪ সাল | বড়দিনের সময়টাই দেখলাম বাড়ির সবাইকার জন্যে সবচেয়ে উপযুক্ত| বাইশে ডিসেম্বর থেকে পয়লা জানুয়ারী (২০১৫) হলে সবচেয়ে ভালো | হাওয়াই বললে শুধু একটা দ্বীপ বলা ভুল হবে | হাওয়াই আসলে হচ্ছে আটটা দ্বীপের সমন্নয় |
এছাড়াও অসংখ্য ছোট ছোট দ্বীপ আছে হাওয়াইয়ান দ্বীপের চেনে | সংখ্যায় প্রায় দেড়শ | বহুদিন আগে নিউজিল্যান্ডের আশে পাশের দ্বীপ গুলোর সঙ্গে সাউথ আমেরিকা এবং ক্যারিবিয়ান দ্বীপের লোকেদের বাণিজ্যের যোগাযোগ ছিল | ব্যবসায়ীরা ‘ক্যানু’ তে (canoe) সুদূর জলপথ পাড়ি দিত | আমি সেসব কিছুই জানতাম না | কি করে এই দ্বীপগুলো তৈরী হয়েছিল বা এখনো হচ্ছে তা জানতে হলে “প্লেট থীয়রী” নিয়ে আলোচনা শুরু করতে হবে | সেটা জানতে হলে একটু রিসার্চ করতে হবে | এইটুকু বলতে চাই যে “চেন অফ আইল্যান্ড” কে আপনি “আর্কিপেলাগো” বলেও ডাকতে পারেন | ধরিত্রীমাতার প্যাসিফিক প্লেট- টা আস্তে আস্তে করে সরে যাচ্ছিল উত্তর পশ্চিম দিকে ৩২ মাইল করে প্রত্যেক মিলিয়ন বছরে | এই কারণে উত্তর পশ্চিম দিকের দ্বীপ গুলো বয়সে বড় এবং আয়তনে ছোট |
এই দ্বীপগুলোর জন্ম শুরু হয়েছিল ২৮ মিলিয়ন বছর আগে | সবচেয়ে প্রথম উত্তর পশ্চিমের দ্বীপটার নাম হলো ‘দি কিওর আয়্টল’ বা “The Kure Atoll”. হাওয়াই হচ্ছে সবচেয়ে দক্ষিন পূর্ব দিকের দ্বীপ এবং বয়স মাত্র ৮ লক্ষ বছর | সমস্ত দ্বীপগুলোরই সৃষ্টি হয়েছিল আগ্নেয়গিরির অগ্নুথ্পাত থেকে | এটা আজও হয়ে যাচ্ছে এবং হয়ে যাবেও | এই সব তথ্য আমি হাওয়াই যাবার আগেই তৈরী করেছিলাম | আপনাদের সঙ্গে ভাগ করার জন্যে লিখলাম | অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি আমাদের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু কল করে বলল ওর হাওয়াইতে একটা টাইমশেয়ার কন্ডমিনিয়াম আছে এবং ও সেটা আমাদের বুক করে দিতে পারে এক সপ্তাহের জন্য | আমাদের কোনো আপত্তি নেই | উল্লসিত হয়ে সম্মতি দিলাম – বন্ধু বলেছিলো যে ওর কাছে শুধু বিগ আইল্যান্ড এর একটা কন্ডমিনিয়াম আছে এবং সেটাই আমাদের সবচেয়ে ভালো লাগবে কেননা ওই সময় অন্য সব আইল্যান্ড গুলোতে অনেক বেশি ভিড় হয় | এই প্রসঙ্গে বলে রাখি ‘পার্ল হার্বার’ হচ্ছে ওয়াহু তে এবং টুরিস্ট সিজনে না যাওয়াই ভালো | আমি বন্ধুর পরামর্শ নিয়ে ঠিক করলাম হাওয়াইতেই যাব | ও টাইমশেয়ার বুক করে দিল | আমিও টিকেট কেটে ফেললাম | আমরা বেরোচ্ছি ২২-এ ডিসেম্বর এবং ফিরছি ২৯-এ ডিসেম্বর | সকাল সাড়ে নটায় ফ্লাইট | আমি এয়ারপোর্ট শাটলকে কল করে এয়ারলাইন্স এর নাম এবং ফ্লাইট নম্বর বলে আমাদের বাড়ি থেকে তুলে নিতে বললাম | ফ্লাইট এর সময় জানাতে ওরা আমাকে বলল যে ওরা আমাদের সকাল সাড়ে ছটার সময় তুলে নেবে | অর্থাৎ আমাদের সকাল সাড়ে পাঁচটার সময় উঠতে হবে | আমার দুই মেয়েই চেঁচামেচি শুরু করে দিল | একটু দেরী করে ফ্লাইট নিলে হত না? বুঝিয়ে বললাম যে আরো দেরী করে ফ্লাইট নিলে আমরা হাওয়াই তে সন্ধ্যেবেলায় পৌঁছব যেটা আমি চাই না | শীতের দিনে সকাল সাড়ে ছটার সময় বেশ অন্ধকার | সাড়ে পাঁচটার সময়তো ঘুরঘুট্টি অন্ধকার |
কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে ছটা বাজতে পাঁচ মিনিট আগে শাটল ভ্যানটা বাড়ির সামনে হাজির | আমার সেল ফোনে একটা টেক্সট মেসেজ এলো “Your driver from Super Shuttle is at your driveway – Please let him load your luggage in the van”. কয়েক বছর আগেও এই সব ব্যাপারগুলো চিন্তাও করা যেত না! শাটল ভ্যান সাধারনতঃ যতগুলো সিট থাকে সেগুলো ভর্তি করতে করতে যায় | ড্রাইভার বলল যে ও আর মাত্র একটা ফ্যামিলি তুলবে | ড্রাইভার অন্য ফ্যামিলিটাকে তুলে নিল | একটা সাদা ফ্যামিলি | দুজন উঠলো | স্বামী এবং স্ত্রী | ভ্যানটাতে আটজন বসতে পারে কিন্তু ড্রাইভার কে বাদ দিলে আমরা শুধু ছজন| পাশে বসা অন্য ফ্যামিলির ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “Where are you guys heading to?” ভদ্রমহিলা বললেন, “We are going to Dallas, Texas to see my daughter, and you?” আমি বললাম, “Hawaii”. ড্রাইভারের পাশে বসা সামনের সিট থেকে ভদ্রলোক বলে উঠলেন, “Look, let’s exchange our tickets”! বলেই হো হো করে হাসতে শুরু করলেন | আমার মাঝে মাঝে আমেরিকানদের এই অকপট সারল্য ভালো লাগে | আমি কথা বলছিলাম চোখ বুঁজে | বাসের মধ্যে চোখদুটো কখন যে সত্যিকারের বুঁজে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বুঝতে পারিনি | ঘুমটা ভাঙল লস এঞ্জেলেস ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে পৌঁছবার পর | সাড়ে সাতটা বাজে | বাস থেকে নেমে টিকেট কাউন্টারে লাগেজ চেক ইন করে বোর্ডিং পাস নিয়ে একটা ভালো করে কফি বানিয়ে আমাদের Departure lounge-এ গিয়ে বসলাম | সাড়ে নটার সময় সামনে গিয়ে পিছনে গিয়ে অনেক পাঁয়তারা করে প্লেন ছাড়ল নটা পঞ্চাশে | কুড়ি মিনিট লেট !
বেলা তিনটে পঞ্চাশে কোনা এয়ারপোর্টে প্লেনটা পৌঁছলো | মান্ধাতার আমলের এয়ারপোর্ট ! প্লেনের সিঁড়ি দিয়ে নেমে বেশ কিছুটা হেঁটে মালপত্তর নামালাম ! সবকিছুই ওপেন এয়ার ! দেখে বেশ হতাশ হয়ে গেলাম | ভেবে দেখলাম ভলক্যানোর জন্য হয়ত এরা কোনো আধুনিক এয়ারপোর্ট গড়েনি | কে জানে কবে ভলক্যানো হয়ত এয়ারপোর্ট টাকে গ্রাস করে ফেলবে! এই প্রসঙ্গে আমি পাঠকদের বলতে চাই যে হাওয়াইতে Peak season- এ গেলে অনেকদিন আগে রেন্টাল গাড়ি বুক করে ফেলতে | অক্টোবর মাসে আমি সব বড় গাড়ি রেন্টাল কোম্পানি গুলোকে কল করেও কোনো রেন্টাল গাড়ি বুক করতে পারিনি | ইন্টারনেট সার্চ করে বহু কষ্ঠে একটা ছোট্ট কোম্পানির থেকে “Enterprise Rent A Car” -এর গাড়ি বুক করেছিলাম লস এঞ্জেলেসে থাকতে থাকতেই | সবকিছু নিয়ে একটা মিনি সিডানের এক সপ্তাহের ভাড়া পড়েছিল ছশ পঁচানব্বই ডলার | Off season-এ গেলে সাড়ে তিনশ ডলারে হয়ে যেত | “Enterprise Rent A Car”-এর বুথে আমার রিসার্ভেসন রিসিটটা দেখাতে ওরা বলল যে আমি যেন একটা মিড সিডান বা অন্য কিছুর আপগ্রেড নিয়ে নিই | কারণ আমার মিনি সিডান-এর ট্রাঙ্ক স্পেস নাকি ভীষণ কম | আমাদের কেমন যেন খটকা লাগলো | মিনি সিডান থেকে মিড সিডান এর আপগ্রেড নিলে আরো সাড়ে তিনশ ডলার গচ্ছা দিতে হবে | আমি ওদের বললাম আমি মিনি সিডানটার ট্রাঙ্ক স্পেস দেখতে চাই | যদি দেখি ওটা ছোট, তাহলে আমি আপগ্রেডটা নিয়ে নোব | ওরা আমাকে গাড়ির চাবিটা দিয়ে বলল যে তোমার জন্যে যে গাড়িটা আমরা দিয়েছি, সেটা গিয়ে দেখো | যদি দেখো তোমাদের মালপত্র ঢুকছেনা , তাহলে আমরা তোমাকে একটা বড় গাড়ি দোবো | চাবি নিয়ে পার্কিং লটে গিয়ে দেখি গাড়িটা হলো একটা ‘ফোর্ড ফিয়েস্তা’ | ট্রাঙ্ক খুলে দেখি আমাদের সব লাগেজ অনায়াসে ঢুকে গেল | আমরা আর কথা না বাড়িয়ে, ভিতরে না গিয়ে সোজা আমাদের নতুন আস্থানার দিকে রওনা দিলাম |
গন্তব্যস্থান বার করতে কোনো অসুবিধা হয়নি জিপিএস-এর সৌজন্যে | মিনিট চল্লিশ পরে সোজা গন্তব্যে গিয়ে হাজির | ক্যালিফোর্নিয়াতে দীর্ঘদিন থাকার পরে চওড়া রাস্তায় চালিয়ে চালিয়ে হাওয়াই-এর রাস্তাগুলো বড্ড সরু সরু বলে মনে হচ্ছিল | রাস্তার স্পিড লিমিটও অনেক কম | বেশির ভাগ রাস্তারই স্পিড লিমিট হলো ঘন্টায় ৪৫ মাইল | ফ্রিওয়ে গুলোতে মাত্র ৫৫ মাইল | ফ্রিওয়ে বলতে গেলে খুব কম | বেশির ভাগই হলো লোকাল রাস্তা এবং এক দুই ব্লক গেলেই একটা করে ট্রাফিক লাইট | গাড়ি চালানো বেশ বিরক্তিকর | টাইমশেয়ার কন্ডমিনিয়ামে গিয়ে পৌঁছলাম দুপুর আড়াইটে নাগাদ | জিনিসপত্র নামিয়ে এককাপ চা খেয়ে দেখা শুরু করলাম দিনের বাকি সময়টা তে কি করা যেতে পারে | রেজিস্ট্রেশন অফিসে আমাদের বলল আজকে তোমরা ‘লু আউ’ দেখতে যেতে পারো | ঠিক করলাম যাব | আমার বন্ধু সন্ময় আমাকে বলেছিল হাওয়াই গেলে ‘লু আউ’ দেখতে যেন না ভুলি | এখন বাজে সাড়ে চারটে ! ‘লু আউ’ শুরু সন্ধে সাতটায় | টিকেটের দাম ৬৫ ডলার এক একজনের | টিকেটের সঙ্গে শো, ড্রিংক এবং ডিনারের পায়সাও ধরা আছে| ব্যাপারটা মন্দ নয়! রেজিস্ট্রেশন অফিসেই টিকেট কেটে ঘরে ফিরে মুখ টুখ ধুয়ে পৌনে ছটা নাগাদ বেরিয়ে পরলাম | পনের মিনিট আগে অর্থাৎ পৌনে সাতটার সময় গন্তব্যস্থানে পৌঁছে গেলাম
‘লু আউ’ এর স্টেজের পেছনে প্রশান্ত মহাসাগর | ‘লু আউ’-এর বাংলা মানে হচ্ছে পার্টি বা ফিস্ট এবং নাচগানের সংমিশ্রণ | খাবারের মধ্যে ‘পয়’ (Poi), ‘কালুয়া পিগ’ (Kahlua Pig), ‘পোক’ (poke), ‘লমি স্যামন’ (Lomi salmon), ‘অপিহি’ (Opihi), ‘হাউপিয়া’ (Haupia)এবং ‘বিয়ার’ (beer)| কোনটা কি খাবার জানতে হলে ইন্টারনেট সার্চ করতে হবে | ইতিমধ্যে দেখি দুজন লোক মাটির তলা থেকে থেকে কলাপাতায় মোড়া একটা গোটা শুয়োর খুঁড়ে বার করলো | আমি ছোটবেলা থেকে মাছ, পাঁঠা বা মুরগির মাংস খেয়েই অভ্যস্ত | কোনোদিন পর্ক বা বীফ খাওয়াটা বেশি পছন্দ নয় | সুতরাং প্রচুর ভাত, স্যালাড আর স্যামন খেয়ে শো দেখার জন্যে বসে পড়া গেলো | ‘লু আউ’ এর নর্ত্তক এবং নর্ত্তকীরা স্বল্পাবেশ পরিহিত বা পরিহিতা হলেও নাচগুলো ছিল যথেষ্ট সংযত | নাচগুলো আসলে দেবতাদের জন্যে উৎসর্গ করা | অনেকটা আমাদের ‘ভারতনাট্যম’ বা ‘ওডিসি’ নাচের মতো | কিন্তু আমাদের দেশের নাচের সঙ্গে আকাশ পাতাল ফারাক | রসনার তৃপ্তি হলো সুন্দর একটা ডিনার খেয়ে এবং মানসিক তৃপ্তি হলো সুন্দর একটা অনুষ্ঠান বা ‘প্রোগ্রাম’ দেখে | রাত প্রায় দশটায় অনুষ্ঠান দেখে বেরিয়ে এসে সাড়ে দশটা নাগাদ আবার কন্ডোমিনিয়ামে ফিরে এসে ঘুমোতে গেলাম | প্রায় দশঘন্টা লম্বা টানা ঘুম দিয়ে সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ ঘুম ভাঙলো | মেয়েরা বললো ওরা বিচে গিয়ে সাঁতার কাটবে | স্ত্রী বললো ও আরো কিছুক্ষন ঘুমোবে | তথাস্তু ! স্ত্রীকে রেখে তিনজনে বেরিয়ে পড়লাম |
সাঁতার কাটার মতো বিচ বিগ আইল্যান্ডে কমই আছে | আমরা একটা ন্যাশনাল পার্ক ইনফরমেশন সেন্টারে গিয়ে হাজির হলাম বিচ কোথায় জিজ্ঞাসা করার জন্যে | এখানে একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হলো | নাম আলবার্ট মোনিজ |
অনেকক্ষণ ধরে গল্প করেছিলাম | উনি আমাকে বললেন বিগ আইল্যান্ডে চারটে ন্যাশনাল পার্ক আছে | আমরা আর মাত্র পাঁচদিন থাকবো শুনে বললেন যে অন্ততঃ ন্যাশনাল পার্কগুলো যেন আমরা দেখি | কয়েকটা অদ্ভূত কথা বললেন যা অবাক করার মতো | আমি শুনছিলাম | একটা ন্যাশনাল পার্কের নাম বললেন যা হলো ‘পুরুহনুয়া ও হোনাউনাউ ন্যাশনাল হিস্টোরিক পার্ক – (Puʻuhonua o Hōnaunau National Historical পার্ক)’ | আগেকার দিনে যেসব হাওয়াইয়ান ওদের ‘কাপু’ বা আইন শৃঙ্খলা লঙ্ঘন করতো তাদের একজন পুরোহিত একটা জায়গায় এনে কিছুটা হেডস্টার্ট দিয়ে ছেড়ে দিতো | ওকে ফলো করতো এক দঙ্গল হাওয়াইয়ান রাজার সৈন্য | ধরুন একটা লোক মিনিট পনেরোর হেডস্টার্ট পেলো | ওকে কয়েক মাইল দৌড়ে এবং আরো কয়েক মাইল সাঁতার কাটতে হতো ওই পার্কে পৌঁছনোর জন্যে | ওই পার্কে ঠিকমতো পৌঁছতে পারলে তাকে অপরাধের থেকে মুক্তি দেওয়া হতো | কিন্তু এর মধ্যে ধরা পড়লেই সাক্ষাৎ মৃত্যু | ব্যাপারটা বেশ কঠিন | পেছনে যারা ধেয়ে আসছে তারা প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত সৈন্যের দল | সুতরাং প্রাণে বাঁচার জন্য আসামিকে অসম্ভব সংগ্রাম করতে হতো | এই পার্কটার নাম কয়েকবার বদল হয়েছে | এটাকে বর্তমানে ‘সিটি অফ রিফিউজ ন্যাশনাল পার্ক – (City of Refuge National Park)’ বলেও ডাকা হয় |
মিঃ মোনিজ এ ছাড়াও আমাদের (‘হাওয়াই ভলকানোস ন্যাশনাল পার্ক – Hawaii Volcanoes National Park)’ দেখতে বললেন | এছাড়া আরো দুটো ন্যাশনাল পার্কের কথা বললেন | একটার নাম ‘কালোকো হনোকহাউ ন্যাশনাল হিস্টোরিক্যাল পার্ক – Kaloko-Honokohau National Historical Park’ যেখানে গেলে নাকি কানাকা মাওলি লোকেদের আত্মা এবং আধ্যাত্বিকতা বিরাজ করে | হাওয়াই আইল্যান্ডের পশ্চিম দিকের তটরেখায় গরম লাভার জন্যে জলটা গরম | অনেকেই বুঝতে পারেনা কেন হাওয়াইয়ানরা এই গরম লাভার মাঠের ওপরে থাকতো | কারণটা ছিল বোধহয় ‘কালোকো হনোকহাউ’এর আধ্যাত্বিকতাবাদের জন্যে | যে সব হাওয়াইয়ানরা এখানে প্রথমে এসেছিলেন তারা এই পার্কের প্রত্যেকটা পাথর এবং গাছের মধ্যে এই আধ্যাত্বিকতা অনুভব করতেন | ভদ্রলোক আরও একটা ন্যাশনাল পার্কের নাম বললেন ‘পুউকোহলা হেলাউ ন্যাশনাল হিস্টোরিক পার্ক – (Puʻukoholā Heiau National Historic Park’ | হাওয়াই দ্বীপের উত্তর পশ্চিম দিকে এই দ্বীপটির অবস্থান | ‘পুউকোহলা হেলাউ’ কথাটার মানে হলো ‘তিমি মাছের পাহাড়ের ওপরের মন্দির – Temple on the hill of the whale’ | ন্যাশনাল পার্কগুলোর কথা বলতে বলতে ভদ্রলোকের চোখ দুটো বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো | যেন উনি ওই পার্কে পৌঁছে গিয়েছেন | আমি অনেকক্ষণ ধরে ওনার কথা শুনছিলাম | মেয়েরা উসখুস করছিলো | অবশেষে ভদ্রলোক গুগলের (google) একটা পাতা বার করে আমাকে ওনার ছবি দেখালেন | আমি পরে ভালো করে দেখবো বলে এবং ওনাকে সমস্ত মূল্যবান তথ্যের জন্যে অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলাম | আমার মেয়েরা বন,জঙ্গলের মধ্যে প্রায় আধ মাইল হাঁটার পরে একটা বিচ খুঁজে পেলো | কিন্তু কালো পাথরে ভর্তি এবং ভীষণ স্রোত | এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছু লোকজন দেখলাম | তারা পিকনিক করছে | আধ ঘন্টা বিচে বসে মন মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো | দলবল নিয়ে গাড়িতে উঠে বাড়ি চলে এলাম | গুগল সার্চ করে ভদ্রলোকের নাম করতেই দেখলাম উনি ঘোড়ার জিন (saddle) তৈরী করেন | আমার হাওয়াইতে আসার এবং বাড়ির অন্য লোকেদের হাওয়াইতে আসার মধ্যে পার্থক্য আছে | আমার মেয়েরা একদিন সমুদ্রে সাঁতার কাটবে এবং একদিন জিপলাইনিং করবে | দুদিন অলরেডি কেটে গেছে |
বাকি আছে তিনদিন | এই প্রসঙ্গে বলে রাখি বিগ আইল্যান্ডের দুটো দিক আছে | এদের নাম হলো ‘কোনা’ এবং’ হিলো’ | ব্যাপারটা বোঝানোর জন্যে একটা হাওয়াইয়ের ম্যাপ যোগ করে দিলাম |
কোনার আবহাওয়া প্রায় সবসময় উষ্ণ | উত্তর দিকে সাঁতার কাটার মতন সাদা বালির বিচ আর দক্ষিণ দিকে সুন্দর তটভূমি | দক্ষিণ দিকের বাড়তি পাওনা হলো নামকরা ‘কোনা কফি’ | এটা অনেকটা শহুরে | ভালো ভালো রেস্তোরাঁ এবং বার কোনাতে দেখা যায় | এটাকে কাইলুয়া কোনাও বলা হয় | বিগ আইল্যান্ডের রাজধানী কিন্তু হলো ‘হিলো’ | এটা যেন একটা ‘গ্রীষ্মমন্ডলীয় রেনফরেস্ট – Tropical Rain Forest’ | এটা কোনো ‘পর্যটন শহর – Tourist Town’ নয় কিন্তু আপনার একটুতেই ভালো লেগে যাবে | লোকজন হাসিখুশি এবং বন্ধুত্বপূর্ণ | সময় যেন খুব আস্তে আস্তে কাটে এখানে | অন্ততঃ ‘কোনা’র থেকে | পরের দিন ঠিক করলাম ‘ভলকানোস ন্যাশনাল পার্ক’ দেখতে যাবো | যেতে গেলে প্রায় দুঘন্টা লাগবে এবং ঘুরে ফিরে প্রায় তিরাশি মাইল পথ অতিক্রম করতে হবে | লস আঞ্জেলেসে থেকে ফ্রিওয়েতে চালিয়ে অভ্যস্ত আমার রাস্তাঘাটগুলো বেশ গ্রাম্য গ্রাম্য লাগছিলো | রাস্তার অবস্থা আগেই বলেছি | যাই হোক দুঘন্টা পরে পৌঁছে গেলাম | প্রায় চার হাজার ফুট উঁচুতে একটা যেন ঘন ‘বৃষ্টি বন’ (rain forest) | রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা খুব কম | ব্যাপার স্যাপার দেখে শুনে মনে হচ্ছিলো যেন জুরাসিক পার্কে (Jurassic Park) পৌঁছে গেছি | রাস্তার এদিকে ওদিকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে |
কিলাউইয়া আগ্নেয়গিরি হলো ভলকানোস ন্যাশনাল পার্কের মধ্যে সবচেয়ে সক্রিয় | প্রত্যেক বছর প্রায় দেড় লাখের ওপরে টুরিস্ট এই পার্কে বেড়াতে আসেন এবং অনেক মানুষ এটাকে নিষ্ঠার সঙ্গে পরিদর্শন করেন | প্রথমেই গেলাম ‘ পরিদর্শক কেন্দ্রে (visitor center)’ | সুন্দর করে আপনি কতকক্ষনের জন্যে পার্কে এসেছেন এবং ওই সময়ের মধ্যে কি কি করতে পারেন তা লেখা আছে | আমরা ঠিক করলাম প্রথমে লাভা টিউবের গুহা (Lava Tube Cave) দেখবো বলে | এটা যেন একটা পাইপের মতো এবং শুধু পাইপের দেওয়াল গুলো লাভার তৈরী – কোনো কংক্রিট বা ধাতু দিয়ে তৈরী নয় | লাভা টিউব অগ্নুৎপাত হবার সময় হাওয়া এবং লাভার সংমিশ্রনে একটা পাইপের আকার ধারণ করে | প্রকৃতি যখন আস্তে আস্তে শান্ত হতে থাকে, এই টিউবের ওপরে মাটি জমে এবং টিউবটি আস্তে আস্তে মাটি ঢাকা পরে যায় | পরবর্তী অগ্নুৎপাতের সময় এই টিউব দিয়ে জলের মতো লাভা বইতে থাকে বা অগ্নুৎপাত বন্ধ হলে লাভায় ভর্তি হয়ে লাভা টিউবটা বুঁজে যায় | সবাই মিলে লাভা টিউব দেখতে চললাম | এটার নাম থার্সটন লাভা টিউব (Thurston Lava Tube) – এখনো সক্রিয় |
এটা যেন একটা পাইপের মতো এবং শুধু পাইপের দেওয়াল গুলো লাভার তৈরী – কোনো কংক্রিট বা ধাতু দিয়ে তৈরী নয় | লাভা টিউব অগ্নুৎপাত হবার সময় হাওয়া এবং লাভার সংমিশ্রনে একটা পাইপের আকার ধারণ করে | প্রকৃতি যখন আস্তে আস্তে শান্ত হতে থাকে, এই টিউবের ওপরে মাটি জমে এবং টিউবটি আস্তে আস্তে মাটি ঢাকা পরে যায় | পরবর্তী অগ্নুৎপাতের সময় এই টিউব দিয়ে জলের মতো লাভা বইতে থাকে বা অগ্নুৎপাত বন্ধ হলে লাভায় ভর্তি হয়ে লাভা টিউবটা বুঁজে যায় | সবাই মিলে লাভা টিউব দেখতে চললাম | এটার নাম থার্সটন লাভা টিউব (Thurston Lava Tube) – এখনো সক্রিয় |
নীচের ছবিতে যা লেখা আছে তার বাংলা তর্জমা করলে এইটা দাঁড়াবে “আপনার সামনে আছে বিশ্বের বৃহত্তম আগ্নেয়গিরি | কুড়ি মাইল সামনের দিকে এগিয়ে গেলে আপনার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ‘মউনা লুয়া’ আগ্নেয়গিরির শিখর | যার উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ (sea level) থেকে ১৩৬৭৭ ফুট উঁচুতে এবং সমুদ্রের মেঝে (ocean floor) থেকে ৩১০০০ ফুট উঁচুতে | আয়তনে ১০০০০ ঘন মাইল নিয়ে ‘মউনা লুয়া’ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পাহাড় |
এই ভলকানোর বিশাল ওজন তৈরী হয়েছে পরপর গলিত লাভার অগ্নুৎপাত হয়ে | প্রত্যেকটি স্বতন্ত্র লাভা স্রোত গড়ে বারো ফুট করে চওড়া | এটাকে বলা হয় ঢাল আগ্নেয়গিরি (shield volcano) – যে ভলকানোগুলো পাশের পাঁচিল বা দেওয়াল (side wall) আস্তে আস্তে ঢালু হয়েছে | মনে হবে যেন একজন যোদ্ধার ঢাল উল্টে দেওয়া আছে | মউনা লুয়ার হাজার হাজার শতাব্দী এবং অগুনতি অগ্নুৎপাত লেগেছে বর্তমান অবস্থায় পৌঁছতে | গত ১০০ বছরে মউনা লুয়াতে মোট ১৮ টি অগ্নুৎপাত হয়েছে এবং পরের অগ্নুৎপাতটি যে কোনো মুহূর্তে হতে পারে | মউনা লুয়া হাওয়াইয়ের পাঁচটি আগ্নেয়গিরির মধ্যে বৃহত্তম এবং হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের অর্ধেকটা জমি নিয়ে আছে | বেশির ভাগ আগ্নেয়গিরি সমুদ্রের মধ্যে বিলীন হয়ে আছে | আয়তনে মউনা লুয়া ওয়াশিংটন রাজ্যের (state) মাউন্ট রেনিয়ারের চেয়ে ১০০ গুন্ বড় (যার উচ্চতা মউনা লুয়ার সমান} | ভলকানো ন্যাশনাল পার্কের মধ্যে আরো কতকগুলো ফ্রেমে আটকানো ছবি আছে | একটা ছবি হলো ওদের ভলকানোর দেবতা পেলে (pele) | না আমি ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার পেলের কথা বলছি না | ইনি হলেন আগুনের দেবতা যাঁর মহানতায় নাকি দেশের পর দেশ গড়ে উঠেছে |
নীচের ছবিটা হলো- পুরোনো দিনের হাওয়াইয়ানদের ছবি | অগ্নুৎপাত হচ্ছে এবং নৌকায় করে সম্ভ্রম নিয়ে বিস্ফারিত চোখে ওরা অগ্নুৎপাতের দিকে তাকিয়ে আছে | যেন ভগবানকে উপলব্ধি করছিলো |
নীচের ছবিটা হলো- হাওয়াইয়ানদের কাছে পেলের মাহাত্ম্য যে কতটা তা লেখা আছে | বেলা হয়ে আসছিলো | কাল যাওয়া হবে ‘জিপ লাইনিং’ করতে | এখন ফিরে যাচ্ছি ‘হিলো’ থেকে ‘কোনা’ তে | কাল আবার আসবো ‘হিলো’ তে | একটা জায়গায প্রায় মাইল তিনেক রাস্তায ভীষণ কুয়াশা | অত্যন্ত সাবধানে ড্রাইভ করতে হয়েছিল |
ওখানে একটা ‘অবজারভেটোরি’ আছে – এখন বন্ধ এবং পাহাড়ি রাস্তাও বন্ধ | সুতরাং দূর থেকে দেখাই সার | আসলে মউনা লুয়া এবং মউনা কিয়া হচ্ছে পাশাপাশি দুইটি আগ্নেয়গিরি | মউনা কিয়া আসলে মউনা লুয়ার থেকেও ৩৫০ ফুট বেশি উঁচু যদিও মউনা লুয়া আয়তনে বড় | আসল পার্থক্য হলো মউনা লুয়া এখনো সক্রিয় | ১৯১২ থেকে ২০১২-র মধ্যে মউনা লুয়ার বারোবার অগ্নুৎপাত হয়েছে | মউনা কিয়াতে শেষ অগ্নুৎপাত হয়েছে ৪০০০ বছর আগে | এটার জীবন শেষ হয়ে গেছে বলা যেতে পারে | হিলো থেকে কোনাতে আসবার সময় ট্রাফিক লাইটগুলোতে বার বার একটা নাম দেখছিলাম | সেটা হলো ‘কামেহামেহা’ | আসলে একটা ট্র্যাফিক লাইটে গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকার সময় আমি ভালো করে নামটা পড়েছিলাম | কে ছিলেন উনি? জানবার জন্যে বাড়িতে এসেই ল্যাপটপ খুলে বসলাম | যা দেখলাম তাতে হাওয়াইয়ের অনেক ইতিহাস চোখের সামনে যেন খুলে গেলো |
কামেহামেহার কথা‘ কামেহামেহা ১’ (যাঁর আসলে নাম ছিল ‘পাইয়া’) ছিলেন হাওয়াইয়ের প্রথম রাজা যিনি সমস্ত হাওয়াই দ্বীপগুলোকে এক রাজার অধীনে নিয়ে আসেন | এর আগে বিভিন্ন দ্বীপপুঞ্জের রাজারা বা নেতারা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করে বেড়াতেন | পাইয়া সম্ভবতঃ ১৭৫৮ সালের নভেম্বর মাসে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৮১৯ সালের ৮ ই মে দেহত্যাগ করেন | পাইয়া শব্দটির মানে হলো ‘শক্ত খোলের কাঁকড়া’ বা ‘Hard shelled crab’ | ওনার বাবার নাম ছিল ‘কেওয়া’ এবং মায়ের নাম ছিল ‘কেকুইয়াপিয়া’ যিনি ছিলেন রাজা ‘আলাপাই’ এর মেয়ে | কথিত আছে যে ‘কোকোইকি’ নাম একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র দেখা দিয়েছিলো পাইয়ার জন্মের আগে | মনে রাখবার মতো ঘটনা ঘটেছিলো এই কিংবদন্তি রাজার জন্মের বছরে | ‘হ্যালির ধূমকেতু’ও এই বছরে দেখা গিয়েছিলো | নিজে স্বৈরাচারী স্বভাবের হলেও ‘কামেহামেহা ১’ প্রত্যেক দ্বীপের একজন করে গভর্নর ঠিক করে দেন এবং মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ করে দেন | উনি ‘কাপু’ পদ্ধতি খুব কঠোর ভাবে চালু করেন এবং শক্তিশালী নেতারা যাতে সাধারণ মানুষের ওপরে অত্যাচার চাল না করতে পারে তার ব্যবস্থা করেছিলেন | হাওয়াইতে রাজতন্ত্র চলেছিল ১৭৯৫ সাল থেকে ১৮৯৫ সাল পর্যন্ত্য | ‘কামেহামেহা ১’ থেকে ‘কামেহামেহা ৫’ পর্যন্ত কামেহামেহারা রাজত্ব করেন | ষষ্ঠ এবং সপ্তম রাজার নাম ছিল যথাক্রমে ‘লুনালিলো’ এবং ‘কালাকাউয়া’ | হাওয়াইয়ের শেষ শাসক ছিলেন ‘লিলিউওকালানি’ নামের এক মহিলা | উনি রাজত্ব করেন ২৯ জানুয়ারী, ১৮৯১ থেকে ১৭ জানুয়ারী ১৮৯৩ পর্যন্ত্য | ওই বছর হাওয়াইয়ের রাজতন্ত্র পরাস্ত হয় আমেৰিকানদের কাছে এবং ওই রানী কারাগারে বসে ‘আলোহা ওই’ এবং আরও অনেক বই লেখেন | উনি এই সময় আত্নজীবনীও লিখেছিলেন | তাড়াতাড়ি শুয়ে পরা গেলো | কাল সকাল থেকে আবার হিলোর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করতে হবে ‘জিপ লাইনিং’ এর সব ব্যবস্থা এবং টিকিট কাটা হয়ে গেছে | আমরা যাচ্ছি ‘বোটানিক্যাল ওয়ার্ল্ড অ্যাডভেঞ্চার’ ট্যুরে | মেয়েদের সঙ্গে বাসে করে কিছুদূর গিয়ে ওদের ছেড়ে দিয়ে আমি এবং আমার স্ত্রী ‘বোটানিক্যাল ওয়ার্ল্ড’টা ঘুরে দেখতে লাগলাম | অদভূত অদভূত সব গাছ |
আবার ‘কোনাতে’ ফেরা | সেই কুয়াশাচ্ছন্ন রাস্তাটাতে আবার পড়লাম | এবারে কালকের চেয়েও বেশি অন্ধকার | সাবধানে রাস্তাটাকে পার করে ভালো রাস্তায় পড়ার পরে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলুম | পরের দিন সাঁতার কাটা হবে এবং সময় থাকলে ‘পুরুহনুয়া ও হোনাউনাউ ন্যাশনাল হিস্টোরিক পার্ক’ বা বর্তমানের ‘সিটি অফ রিফিউজ ন্যাশনাল পার্ক’ বেড়াতে যাওয়া হবে | সুতরাং পরের দিন সকাল সকাল বেরিয়ে পড়া গেলো | বেশ কিছুক্ষন বিচে কাটিয়ে ‘সিটি অফ রিফিউজ’ =এর জন্যে বেরোলাম | আলবার্ট মোনিজ আমাকে আরও একটা জায়গা দেখতে বলেছিলেন যার নাম হলো ‘কেয়ালাকেকুয়া বে – ‘ Kealakekua Bay ‘ | ওখানে ক্যাপ্টেন জেমস কুকের (captain James Cook) নামে একটা স্ট্যাচু আছে | ওই জায়গাটা এবং ওর আশে পাশে র কিছু অঞ্চল কিন্তু অনেক সক্রিয় আগ্নেয়গিরির বলয়ের (volcanic zone) মধ্যে আছে | এই ঘটনাটা ঘটবার সময় সারা হাওয়াইয়ের কিছু কিছু অঞ্চলে আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত হচ্ছিলো এবং মিঃ মোনিজ জায়গাটা দেখবার ভার আমার ওপরে ছেড়ে দিয়েছিলেন | আমি তখনই ঠিক করেছিলাম জায়গাটা দেখি বা না দেখি ক্যাপ্টেন কুকের সম্বন্ধে কিছু বলবো কারণ আমার মনে হয়েছিল ক্যাপ্টেন জেমস কুকের সম্বন্ধে কিছু না বললে আমার এ লেখাটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে |
ক্যাপ্টেন জেমস কুক
ক্যাপ্টেন জেমস কুকের জন্ম হয়েছিল ২৭শে নভেম্বর ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ারে | উনি ছিলেন ব্রিটিশ রাজকীয় নৌবাহিনীর (Royal Navy) একজন অনুসন্ধানকারী নাবিক যিনি খুব ভালো ম্যাপ বুঝতে এবং আঁকতে পারতেন | কুক প্রথমবার হাওয়াইতে পদার্পন করেছিলেন ১৭৭৮ সালের জানুয়ারি মাসে এবং ১৭৭৯ সালের ফেব্রূয়ারি মাসে স্থানীয় হাওয়াইয়ানদের হাতে তাঁর মৃত্যু হয় | অনেক ঘটনা ঘটেছিলো এই সময়ের মধ্যে | সে ইতিহাস আজকে ঘাঁটতে চাইনা | ঠিক করেছিলাম ক্যাপ্টেন কুকের ‘কেয়ালাকেকুয়া বে’ (Kealakekua Bay) অন্য সময় এসে দেখবো | রাস্তা কখন ভলকানোর জন্যে বন্ধ হয়ে যাবে জানা নেই | সুতরাং বিচে সাঁতার কেটে বিচের বাথরুমে চান করে চললাম ‘সিটি অফ রিফিউজে’র দিকে |
‘সিটি অফ রিফিউজ
এই শহরে (শহর না বলে জায়গা বলা ভালো) সমুদ্রাটা যেন বাড়ির পেছনে একটা লেক | সমুদ্র যে এতো শান্ত হতে পারে তা এখানে না এলে বোঝানো যাবেনা | কতগুলো টিকি (TIKI) মূর্তি আচমকা দেখলে ভূত বলে মনে হবে | এছাড়া কাঠের পাঁচিলের মধ্যে কতকগুলো কাঠের বাড়ি | ‘কাপু’ লঙ্ঘনকারীরা দুষ্কৃতীরা এখানে এলে কেউ এদের গায়ে হাত দিতে পারতো না | অর্থাৎ সাক্ষাৎ যমের হাত থেকে মুক্তি | ঘোরা হলো হাওয়াই | কাল সকাল এগারোটায় ‘কোনা’ এয়ারপোর্ট থেকে প্লেন ছাড়বে | মেয়েদের খুব মন খারাপ | এয়ারপোর্টের কাছে গিয়ে দেখলাম মাত্র সকাল আটটা বাজে | তাড়াতাড়ি টাইম শেয়ারটা ছেড়ে দিয়েছি | মেয়েরা বলল রাস্তায় আসার সময় একটা স্টেট পার্ক দেখেছে ওরা | আমরা দশটার সময় ‘চেক ইন’ করলেই হবে | তা হলে হাতে দু ঘন্টা সময় | আমি ওদের মনটা যেন পড়তে পারছিলাম | আসলে ওরা হাওয়াইয়ের প্রেমে পরে গেছে | গাড়িটা ঘুরিয়ে নিয়ে একটা রিজিওনাল পার্কের মধ্যে ঢুকে গেলাম | পার্কটাতে ঢোকবার মুখে একটা সতর্কবাণী যাতে আমাদের সাবধান করে বলা আছে সতর্ক হয়ে ড্রাইভ করতে কারণ সামনের রাস্তা অনুন্নত |
কিছুক্ষন পরে গাড়ি আবার ঘোরানোর সময় চাকাটা যেন মাটিতে বসে যাচ্ছিলো | অনেক কায়দা করে গাড়িটাকে যখন শক্ত মাটিতে তুললাম, তখন যে কি অনুভূতি হয়েছিল তা বলে বোঝাতে পারবো না | হাওয়াইতে যেখানেই তাকাতাম, মনে যেন একটা সম্ভ্রম এবং বিস্ময় দেখা দিতো | ধরিত্রী মাতার মহিমা বোঝার ক্ষমতা আমাদের আছে কি? আস্তে আস্তে এয়ারপোর্টে পৌঁছে গাড়ি ফেরত দিয়ে চেক ইন করে যতদূর চোখ যায় তাকিয়ে থেকে প্রাণ ভরে বাতাসটা অনুভব করার চেষ্টা করছিলাম | মনে পড়ছিলো দুতিনদিন আগে যখন আমরা বিচের খোঁজ করছিলাম তখন গাড়িটা পার্ক করে একটা দোকানে (party store) হন্তদন্ত হয়ে ঢুকে পড়েছিলাম দোকানের মালিককে বিচ কোথায় জিজ্ঞাসা করার জন্যে | দোকানটাতে পাঁচজন বয়স্ক মহিলা এবং একজন পুরুষ ( সম্ভবত দোকানের মালিক) জমিয়ে আড্ডা মারছিলেন | আমি বলেছিলাম ‘আলোহা (ALOHA)’ |
ভদ্রলোক আমাকে সুন্দর ভাবে বলেছিলেন হাওয়াইয়ানদের ‘ALOHA’ র মধ্যে আছে পাঁচটি শব্দ | ALOHA র ‘A ‘ শব্দটি এসেছে AKAHI থেকে – যার মানে হলো উদারতা যেন কোমলতার সঙ্গে প্রকাশ করা হয়, ‘L’ শব্দটি এসেছে LOKAHI থেকে – যার মানে হলো ঐক্য প্রকাশ করার সময় যেন সবাইকার মধ্যে যেন সাদৃশ্য এবং সামঞ্জস্য থাকে, ‘O’ শব্দটি এসেছে ‘OLUOLU’ থেকে – কোনো ব্যাপারে মতের মিল হলে তা যেন মাধুর্যের সঙ্গে প্রকাশ করা হয়, ‘H’ শব্দটি এসেছে ‘HAAHAA’ থেকে – যার মানে হলো অবমানিত অবস্থা যেন নম্রতার সঙ্গে গ্রহণ করা হয় এবং শেষ ‘A’ বা ;AHONUI’ শব্দটির মানে হলো ধৈর্য্য ধরার মতো অধ্যবসায় যেন মানুষের মধ্যে থাকে | আমি বুঝেছিলাম উনি কোনো একলা মানুষের জন্যে বলছিলেন না | কথাগুলো যেন একটা সমগ্র সমাজের (অর্থাৎ হাওয়াইয়ান সমাজ) জন্যে বলা হচ্ছিলো | হাওয়াইয়ানরা যখন ‘ALOHA ‘ বলে তখন কথাটার মানেগুলো মনে রেখে বলে | চোখে দেখতে না পারলেও সামনেই পাহাড় এবং সমুদ্র মিলে পেলের মাহাত্ম্যে যে মাইলের র মাইল জমি তৈরী হচ্ছে তা যেন অনুভব করছিলাম | অনুভব করছিলাম কি অসম্ভব শক্তিধর এই পেলে এবং কি অসম্ভব শৃঙ্খলাবোধ এই হাওয়াইয়ানদের | প্লেনে ওঠার আগে চোখ বুজে বলেছিলাম ‘ তোমার স্বার্থপরতাশূন্য আথিতেয়তা এবং শৃঙ্খলাবোধ আমায় মুগ্ধ করেছে হাওয়াই, আমি তোমার কাছে ফিরে আসবো – নিশ্চয়ই ফিরে আসবো’ |