বিস্মরণ
ধুর্জটির অফিসে আসতে আজকাল ভীষণ অনীহা। সারাদিন কাজে অকাজের একঘেয়েমির অনুপ্রবেশ মানিয়ে নিয়েই কোনমতে কাজের সময়টা কাটিয়ে দেয়। অফিসের পরই অসহায় চিন্তার ঘুন পোকারা কুরে কুরে মস্তিস্ক ঝাঁঝরা করে । সন্ধ্যা যত রাতের দিকে এগোয়, তার মন গুটিয়ে যেতে থাকে শামুকের মত। রাতের পর রাত অনিদ্রার প্রেত তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। কোনো অজানা অসহ্য টানাপোড়েন দিশেহারা করে দিয়েছে। তাই অফিসের পর, ধূর্জটি অগুনিত মানুষের মাঝে মিশে গিয়ে পথ চলে নানান্ চালে। পথ চলতি হরেক কিসিমের মানুষের আগে, আবার হয়ত বা পিছিয়ে থেকে। লম্বা পথের চলচ্চিত্রের পটভূমি রোজ একই থাকে। চরিত্ররা ভোল বদলায় ,মুখ গুলিও পাল্টে পাল্টে যায়। ধূর্জটি সময় নিয়ে হাঁটে। দ্রুত বাড়ি ফেরার তাগিদ নেই। কারুকে কিছু বলার নেই – অনুযোগ নেই।
কোলকাতার পথের দু পাশে, সন্ধ্যার আলো মাখা, হালকা ধুলায় আচ্ছাদিত গাছেরা, কৃষ্ণচুড়া, রাধাচুড়া, বট, পিপুল, কদম, নিম বেঁচে থাকার পাথেয় নিজেরাই খুঁজে নেয়, তাদের নিশ্চুপ জ্বালা যন্ত্রনার অনুযোগ শোনার কেউ নেই।
শহরের বুকে এক অনামা মহল্লার কোনো গলির তস্য কানা গলি, যেখানে সন্ধ্যার পর থাকে থাকে উনুনের ধোঁয়া, বাতাসের অভাবে জমাট বাঁধে গলির ঝিমিয়ে থাকা সরকারি আলোর বলয়ে। প্রতি সন্ধ্যায় পরিবেশটা করে তোলে রহস্যময়। সেখানেই একটি নোনা ধরা, সোঁদা সোঁদা গন্ধ মাখানো বাড়ির এক তলার ঘরে তার আস্তানা। ঝলমলে কোলকাতা শহরের ভেতর কিন্তু যেন কত দুরে। ধূর্জটি দেরি করে ওই পরিবেশে পৌঁছতে,যতটা পারে।
ঘটনার সুত্রপাত অনেক কটা দিন বা বলা যেতে পারে অনেক গুলো রাত আগে। সে রাতটা ছিল বেশ গুমোট। মাথায় অস্বাভাবিক রকম ব্যাথা, মাঝরাত অবধি ঘুমাতে না পেরে, বাইরের গলিতে অনেকক্ষণ পায়চারির পর, মাথায় মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে শুয়ে পড়েছিল। ভোরের দিকে হালকা ঘুমের মধ্যে স্বপ্নটা প্রথম দেখে। বেশ চওড়া নদীর তীরে একা দাঁড়িয়ে। নদীর হাওয়ায় জলের ধারে নল খাগড়ারা মাথা দোলায়। বিশেষ আমল দেয়নি। মানুষ ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখে। সেও দেখে। প্রথম কিছু রাতে ওই পরিবেশটা ছিল ঝাপসা, ঠিক স্পষ্ট নয়। এরপর কিছু রাত বাদ দিয়ে, আবার সেই স্বপ্নের ধারাবাহিকতা। ক্রমশ পরিবেশটা স্পষ্টতর হয়, স্থিতিকালের দীর্ঘতা প্রাপ্তি ঘটে। প্রথমে আশ্চর্য হয়েছিল একই স্বপ্নের পারস্পর্যে। প্রথম দিকে কৌতুহলি হয়ে অপেক্ষা করেছে রাত নামার।
কিছু রাত স্বপ্নহীন থেকে যায়। আবার এক রাতে অসহ্য মাথা যন্ত্রনা, পরে ভোরের দিকে আচ্ছন্ন অবস্থায় সেই স্বপ্নের পুনরাবৃত্তি। এই ভাবে রাতের পর রাত কাটে। ধিরে ধিরে স্বপ্নের পরিবেশে চরিত্র সংযোজিত হয়, পটভূমির বিস্তার ঘটে। এখন দেখে নদীর তীরে বিশাল মহীরুহের ছায়া জলের ওপর ছড়িয়ে আছে, হালকা স্রোতে তিরতির করে কাঁপে । বড় গাছের পাশে আবছা ছোট একটি মন্দির। এই ভাবে টুকরো টুকরো ছবি যুক্ত হয়ে স্বপ্নপট ভরাট হতে থাকে। আগে রাতের স্বপ্ন, দিনে আবছা হয়ে যেত। কিন্তু এই ধারাবাহিকতা বাড়িয়ে তোলে চিন্তার ঢেউ, সাথে পাল্লা দিচ্ছে কৌতুহল। শুতে যাওয়ার আগে তীব্র মাথা যন্ত্রনা, বাড়িয়ে তোলে প্রখর অনুসন্ধিৎসা —-এর পর আর কি দেখা দেবে ! আবার বেশ কিছু রাতের পর আবির্ভূতা হয়েছে এক নারী মূর্তি যার শরীরে গাছ কোমরে জড়ানো শাড়ি, মাথার উপর চূড়াখোঁপা শক্ত করে বাঁধা। নল খাগড়া ঝোপের আড়ালে ডিঙ্গি নৌকায় বসে নদীর হালকা স্রোতে পা ভাসাচ্ছে। রাতের পর রাত ধরে স্বপ্নে দেখা টুকরো টুকরো ছবি গুলি একের পর এক জুড়ে গিয়ে, এখন স্বপ্নপট বেশ পূর্নতা পেয়েছে —- “” উঁচু নিচু টিলার ধার ঘেঁসে বয়ে যাওয়া, বেশ চওড়া নদীর তীরে নল খাগড়ার ঝোপ, মাঝ দিয়ে পায় চলা সরু মেঠো পথ শেষ হয়েছে জলের ধারে। একটি ডিঙ্গি নৌকা বাঁধা নল খাগড়ার ঝোপের আড়ালে। মেয়েটি নৌকায় বসে জলের স্রোতে পা ভাসিয়ে যেন কারুর প্রতীক্ষায়। নিথর শারীরি রুপরেখা ঘুরে আছে নদীর উজানে — মনে হয় তাকিয়ে সেদিক পানে কারুর প্রতিক্ষায়। কুয়াশার অবগুন্ঠনে ঢেকেছে মুখাবয়ব । নদীর তীর ঘেঁসা বিশাল এক গাছের ছায়া জলের ওপর ছড়িয়ে পড়ে তিরতির করে কাঁপে। বড় গাছের পাশে একটি ছোট মন্দির।“”
মাঝ রাত আরম্ভ হয় তীব্র মাথা যন্ত্রনা, পরে খাপ ছাড়া হালকা ঘুমের ভিতর স্বপ্নটা চলচ্চিত্রের মত সরে সরে যায়।
দিন পনেরো বাদে —- আবার সেই স্বপ্ন — আর যেন একে স্বপ্ন বলা চলে না। স্বপ্নের সাথে এবার যেন কোন সূদুর থেকে ভেসে আসা কিছু অজানা কথা সাথে অতি চেনা সুরের অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে মস্তিস্কের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। রহস্যময় এই চেনা চেনা সুর, কথাগুলো অনুধাবন করতে পারে না। বেশ কিছু রাত পরে পরে একই সুরের পুনরাবৃত্তিতে, কয়েকটি কথা যেন আভাসে ধরা পড়ে —“” সুসংয়ে, সমসাঙ্গ –সাদা পাহাড়— — মোয়ি পাটুনী —- ।“” —– ধূর্জটির মাথা ঝিমঝিম করে। রাতে আর ঘুমোতে পারে না । প্রায় রাতেই কথাগুলির অনুবেদন মস্তিস্কে যেন ডঙ্কা বাজায় । মস্তিস্ক বিকৃতির পূর্ব লক্ষণ ?? মাঝেই মাঝেই অফিসের সহকর্মীদের বক্র দৃষ্টি যেন কিসের ইঙ্গিত বহন করে ? তাদের তো দোষ দেওয়া যায় না । ধূর্জটি নিজেই বুঝতে পারে তার বর্তমান অবস্থা। সে চিরকাল সদা হাস্যময়, বন্ধুবৎসল। রাতের পর রাত অনিয়মিত ঘুম সাথে ওই স্বপ্ন বা সেই রকমই কিছু দৃশ্যাবলীর পুন:সংঘটন, সেই সঙ্গে মনের ভিতর আবর্তিত হয় বিশেষ সুরলহরী । তার নিজস্বতা বা চরিত্রের স্বাভাবিকতা কে বিরাট এক প্রশ্ন চিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে । আরো বড় চিন্তা বা কোন কিছুর ক্ষীণ আভাস মনের আনাচে কানাচে উঁকিঝুঁকি দেয় — বার বার স্বপ্নে আসা জায়গাটা যেন তার খুব পরিচিত, আর ওই গাছ কোমরে জড়ানো শাড়ি, মাথার উপর চূড়া খোঁপা শক্ত করে বাঁধা নারী দেহ রুপরেখা যেন মনে করাতে চাইছে তার কোনো খুব কাছের মানুষকে — এক বার ফিরে বসলেই বোধ হয় চেনা যাবে, পাওয়া যাবে শরীরি চেনা গন্ধের আভাস । রহস্যময় গানের অচেনা ভাষার কথাগুলি ও সুর যেন আভাসে আরো ধরা দেয়- আরো পূর্ণতা পায়– “সুসংয়ে, সমসাঙ্গ সাদা পাহাড় ছুঁয়ে বয়ে যায় – মোয়ি পাটুনী এখনো অপেক্ষায় আছে ।“
ধূর্জটির পরিবর্তন ক্রমশ: সবার কাছে প্রকট হয়। অফিসের সহকর্মীরা দুরে সরে যেতে থাকে। কাজ কর্মে উদাসীনতা কর্তৃপক্ষের নজর এড়ায় না। শেষে একদিন ধূর্জটির ঘনিষ্ঠ বন্ধু সোমনাথ তাকে অফিসের পর আলাদা ডেকে আন্তরিক ভাবে তার এই আচমকা মানসিক, সেই সঙ্গে শারীরিক পরিবর্তনের কারণ জিজ্ঞাসা করে। অন্তত একজন সহানুভূতিশীল মানুষ কে পেয়ে, অসহায় ধূর্জটি প্রথম স্বপ্ন দেখার রাত থেকে শুরু করে গত বেশ কিছু দিনের দেখা নানা দৃশ্য ও শোনার অনুভূতি বিস্তারিত ভাবে জানালে, সোমনাথ আশ্চর্য হয়, সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়।
সপ্তাহ খানেক বাদে সোমনাথ ফোনে তাকে কলেজ স্কোয়ারের কাছে বিখ্যাত কলেজের গেটে পরের দিন বিকেল চার টের সময়ে আসতে বলে। ধূর্জটি যথাসময় নির্দিষ্ট স্থানে হাজির হয়ে দেখে সোমনাথ তাদেরই প্রায় সমবয়সী ভদ্রলোকের সাথে কথা বলছে। ধূর্জটি কে নিয়ে কাছেই কফি হাউসে বসে কফি দিতে বলে, সোমনাথ ভদ্রলোকের পরিচয় করায় — সুজয় ওই বিখ্যাত কলেজের অধ্যাপক আর সোমনাথের ছোটবেলার বন্ধু। কোনো দ্বিধা না করে, ধূর্জটি পরিস্কার করে সব জানাতে পারে। অন্যান্য কথায় ধূর্জটির মনে হলো, সুজয় বোধহয় সোমনাথের কাছে মোটামুটি সব শুনেছেন। তা’ হোলেও — ধূর্জটি একটু ভয়ে ভয়ে বিস্তারিত সবই জানায়। সুজয় কাঁধের ব্যাগ থেকে একটি খাতা নিয়ে মাঝে মাঝে কিছু প্রশ্ন করেন আর লিখতে থাকেন। ধূর্জটির মনে হয় সুজয় খুবই উৎসাহিত হয়ে উঠেছেন। প্রশ্নোত্তরের পালার শেষে সুজয় ব্যাগে খাতা রাখতে রাখতে বলেন ব্যাপারটা খুবই চিত্তাকর্ষক ও গুরুত্বপূর্ণ। চিন্তিত মুখে বেশ কিছুক্ষণ সুজয় ধূর্জটির দিকে তাকিয়ে থেকে বলেন –“”আমার অনুমান যদি সঠিক হয় তবে এই বিষয়টি একেবারেই বিরল শ্রেনীভুক্ত। হয়ত সুদূর অতিতের কোন স্মৃতি আপনার মানসপটে ভেসে উঠছে।’মোয়ি ‘ নামটা গারো জাতীয় মহিলাদের হয়ে থাকে আর ‘ পাটুনি’ বা ‘পাটনী ‘ হলো খেয়াঘাটের মাঝি। সমসাঙ্গ বহুকাল আগের একটি নদীর নাম। ইতিহাস অনুযায়ী, এই নদীর তীরে গারো সম্প্রদায়ের ধীবরদের বসবাস ছিল। ‘সমসাঙ্গের’ বর্তমান নাম সোমেশ্বরী যার উৎপত্তি গারো পাহাড়ে বা আমাদের মেঘালয়ে, বর্তমানের বাংলা দেশের ভিতর দিয়ে বয়ে গেছে। ‘ মোয়ি’ মেয়েটি সেই নদীর কোনো খেয়াঘাটের মাঝি অথবা ধীবর জাতিরও হতে পারে । আপনার স্বপ্নে শোনা গেছে ‘ সুসং’ শব্দটা, যা নদীর ধারে কোনো জায়গার নাম হতে পারে। যদি সত্যিই এই রহস্যের উদঘাটন করতে চান, তাহলে আমার পরামর্শ হলো — আপনি সোমেশ্বরী নদীর ধারের জায়গা গুলো ঘুরে আসুন, হয়ত কোন জায়গার সাথে পরিচিতি অনুভব করতে পারেন আবার নাও পারেন, আমার মনে হয় সেই সঙ্গে এই স্বপ্ন দেখার পালা শেষও হয়ে যেতে পারে।”” ধূর্জটি স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। মনের ভেতর চিন্তার ঝড়ে এক মানবী মূর্তির ঝাপসা অবয়ব ভেসে ভেসে উঠে মিলিয়ে যায় । কোন অতলে সে তলিয়ে যাচ্ছে, নিজেকে সংযত করতে অপারগ হয়ে ওঠে। সুজয়ের সাথে কথা বলে মানসিক ভার অনেকটা লাঘব হলো ধূর্জটির । সুজয় আবার বলেন “”এর পর থেকে নতুন কিছু দেখলে বা তরঙ্গায়িত নতুন কোনো শব্দ বা সুরের যদি অনুভূতি পান, লিপিবদ্ধ করবেন, রোজনামচা রাখার মত । কারণ আপনার এই অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতে গবেষণার কাজে খুবই গুরুত্ব পূর্ণ হবে। সোমনাথের মাধ্যমে আমার সাথে যোগাযোগ রেখে গেলে ভালো হয়।“”
এর পর সোমনাথের বিবরণী —————–
কফি হাউস থেকে বেরিয়ে, ধূর্জটির হাবভাবে কিছু অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করি। উদভ্রান্ত চোখের দৃষ্টি । আমি পাশে আছি খেয়াল নেই। আচমকা সে একটি চলন্ত বাসে লাফিয়ে উঠে চেঁচিয়ে বললো “” তোর সাথে খুব তাড়াতাড়ি যোগাযোগ করব।” কিছু বলার আগেই বাসটা এক রাশ ধোঁয়া ছড়িয়ে দ্রুত গতি তে উধাও হয়ে গেল। হঠাৎ ঘটনায় কিছুটা হতভম্বিত হয়ে, চিন্তিত মনে বাড়ির পথ ধরলাম।
কাজের ব্যস্ততায় প্রায় পনেরো দিন কেটে গেল, ধূর্জটির কোন খবর নেই। ওর অফিসে ফোন করে শুনলাম– কোন অগ্রিম নোটিশ ছাড়াই, ধূর্জটি কাজে ইস্তফা দিয়েছে। একদিন ধূর্জটির বাড়ি গিয়ে বাড়িওলার সঙ্গে দেখা করি। ভদ্রলোক ভালো মানুষ। আক্ষেপ করে বললেন “” মশাই কি বলব বুঝতে পারছি না। ধূর্জটি বাবু দিন বারো আগে হঠাৎ তিন মাসের ভাড়া অগ্রিম দিয়ে বলে গেলেন কিছু দিনের জন্য কলকাতার বাইরে যাচ্ছেন। কোথায় বা কি কাজে গেলেন কিছুই বলেননি। কি মুশকিল বলুন দেখি ! ওনার কেউ আত্মীয় স্বজন আছে কি না তাও জানা নেই। “” আমিও খুব আশ্চর্য হয়ে, কোনো খবর পেলে জানাব বলে ফিরে এলাম। ভাবচি ধূর্জটি গেল কোথায় !! মোয়ি র খোঁজে বেরিয়ে পড়ল নাকি ! কিছু দিন বাদে একটা চিঠি পেলাম ধূর্জটির থেকে । প্রেরকের ঠিকানা বিহীন সংক্ষিপ্ত চিঠি।
“” সোমনাথ কিছু মনে করিস না, তোকে কিছু না জানিয়ে বেরিয়ে পড়ার জন্য। আসলে – সে দিনের আলোচনা পর তিন দিন ঘুমোতে পারি নি। রোজ সেই এক স্বপ্ন সাথে রহস্যময় গানের সুরে কারো আহ্বান বয়ে নিয়ে আসার অনুভূতি আমায় পাগল করে তুলেছিল। পাগল হয়ে গেলাম। অফিসে ছুটি পেলাম না। তাই চাকরিটা ছাড়তে হলো। মেঘালয়ের বাঘমারা নামে একটি জায়গায় এসেছি। নদীর দেখা পেলাম, আশপাশের জায়গা গুলো ঘুরে দেখছি, কিন্তু পরিচিতির অনুভূতি নেই। জাগ্রত অবস্থাতেও মোয়ির গানের সুর ঘনঘন মনের ভেতর ফিরে আসছে। তুই মানবি কিনা জানি না –আমার দৃঢ় বিশ্বাস মোয়ি আছে, তাকে ঠিক খুঁজে পাব। আবার সময় পেলে লিখব। — ধূর্জটি —“”
ধূর্জটি সত্যি পাগল হয়ে গেছে। চিঠিটা নিয়ে ছুটলাম সুজয়ের কলেজে। সুজয় চিঠিটা পড়ে গম্ভীর হয়ে চুপ করে থেকে বলে ” ধূর্জটির মানসিক অবস্থা যে পর্যায় পৌঁছেচে, আটকানোর চেষ্টা করলে আর বড় কিছু ঘটে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল, ভেবেছিলাম স্বপ্ন সম্পর্কিত প্রাকৃতিক পরিবেশ পরিবেষ্টিত স্থান যদি খুঁজে পায়, বর্তমানের বাস্তবতা ধূর্জটির ভুলটা ভেঙে দিতে পারে কারণ আমার বদ্ধ ধারনা ঘটনাটার পটভূমির সময় কাল বহু বহু যুগ আগের। পরিস্থিতি বুঝলে স্বাভাবিকতা ফিরে পাবে। কিন্তু ঠিকানাটাও দেয়নি। তোর কাছে যা শুনেছি আত্মীয় স্বজন কেউ আছে কিনা কারুর জানা নেই। আরো খবর পেলে জানাস। “”
মনটা আশঙ্কায় ভরে ওঠে। ভাবলাম আর কয়েকটা দিন দেখে ধূর্জটির বাড়িতে আবার যাব।
পরের রবিবার সকালের দিকে ধূর্জটির বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। বাড়ির গলির মুখে বাড়িওলার সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে তিনি বললেন “” আপনার বন্ধু কাল রাতে ফিরে এসেছেন । বাড়িতে যান , আমি যাই বাজারটা সেরে আসি।”” হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে যাই। পরিচিত সেই স্যাঁতস্যাঁতে ঘরের তক্তাপোশে দেখি ধূর্জটি চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। চেহারার পরিবর্তন লক্ষ্য করি। এ কদিনেই বেশ রোগা হয়ে গেছে। আশ্চর্য হয়ে দেখি তার চোখের দৃষ্টি কিন্তু পরিস্কার। একটু খুশি খুশির ভাবও যেন দেখা দিচ্ছে। আমাকে দেখে ধড়মড়িয়ে উঠে বসে বলে “” আজকেই তোর কাছে যেতাম। কিছু মনে করিস না। সে দিন সুজয়ের বাড়ি থেকে ফিরেই ঠিক করে ফেল্লাম – মেঘালয়ে নদীর উৎপত্তির জায়গাটা দেখে আসি, সেই সঙ্গে সেখানে নদীর ধার বরাবর যতটা ঘোরা যায়। অফিসে ছুটি দিল না, তাই চাকরিটা ছেড়েই দিলাম । কিছু টাকা পয়সাও পাওয়া গেল। চল বাইরে যাই, চা খেতে খেতে সব বলব।”” হতভম্ব চোখে মাথা নাড়ি ।
পাড়ার মোড়ের চা এর দোকানে বসে ধূর্জটি তার ভ্রমন কাহিনী শোনায়। গৌহাটি থেকে সে বাঘমারা চলে যায়। সেখানে কারুর কাছে শোনে বহুকাল আগে সুসং নামে রাজ্যের ভিতর দিয়ে সমসাঙ্গ বা সুমসাং নদী প্রবাহিত হত, সূজয় ঠিকই বলেছে –পরে তার নাম হয় সোমেশ্বরী। সোমেশ্বরী গারো পাহাড় থেকে বয়ে গেছে বাংলা দেশে। কেউ ওকে বলেছে নেত্রকোনা যেতে। এরপর ধূর্জটি আশপাশের বেশ কিছু জায়গা ঘুরে বেড়ায় কিন্তু কোথাও তার স্বপ্নে দেখা জায়গার হদিস পায় নি। তাই সে ঠিক করেছে বাংলা দেশের নেত্রকোনার দিকে ঘুরে আসবে। আর এখন নাকি স্বপ্নের দৃশ্যাবলী খুবই গাড় হয়েছে। আর কথা গুলি খুবই স্পষ্ট। “” বুঝলি, আমি এখন নিশ্চিত, মোয়ির সাথে দেখা হবেই।””
এরপর প্রায় তিন মাস কেটে গেছে। বার দুয়েক ধূর্জটির বাড়িতেও গেছি। কোন খবর নেই ।
মাস চারে’ক পর এক দুপুর বেলা চিঠি পাই কোলকাতার এক সরকারি অফিস থেকে, জরুরি ভিত্তিতে দেখা করার অনুরোধ জানিয়ে। যথাসময় হাজির হলে তারা একটি ছোট সুটকেস আর কাঁধের ঝোলা ব্যাগ দেখায় আর বলে ধূর্জটি বোসের পাসপোর্টে নিকট আত্মীয় হিসেবে আমার নাম ঠিকানা থাকায়, আমায় ডেকে পাঠানো হয়েছে। এই ব্যাগ সুটকেস গুলি পাওয়া গেছে বাংলাদেশের সোমেশ্বরী নদীর ধারে বিরিশিরি নামে জায়গার একটি ছোট হোটেল থেকে। পুলিশ এগুলির মালিকের হদিস পায়নি প্রায় দু মাস খোঁজ খবর করেও। বাংলা দেশের ভারতীয় দুতাবাস মারফত এগুলি পেয়ে আমাকে যোগাযোগ করা হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদের যথা সম্ভব উত্তর দিয়ে, ব্যাগ সুটকেস নিয়ে বাড়ি চলে এলাম।
বাড়ি এসে – প্রথমে ঝোলা ব্যাগ হাতড়ে দেখি, জলকাদা শুকিয়ে যাওয়া কিছু জামাকাপড়। এবার সুটকেস খুলতে পেলাম দৈনন্দিন ব্যবহারের জিনিস আর বহুল ব্যবহৃত কিছু সার্ট ট্রাউজার্সের নিচে একটি ডায়রী। ডায়রীর পাতা গুলোয় চোখ বোলাই – বেশির ভাগ পাতা ফাঁকা, কিছু কিছু পাতা লেখায় ভর্ত্তি। বুঝলাম সুজয়ের পরামর্শ মত রোজনামচা লিখেছে ধূর্জটি।
এরপর ধূ্র্জটির ডায়রীর পড়তে পড়তে নিজের মস্তিস্কের সুস্থতা নিয়ে সন্দেহ জাগে – এও কি সম্ভব !! তারিখ গুলো উহ্য রেখে ডায়রীর সারাংশ দিলাম।
–।১০।২০১৭
আজ ঢাকা পৌঁছলাম। নেত্রকোনার যাওয়া বাস গুমটির বেঞ্চে বসে আছি। কাল সকালে বাস। ঢাকায় সন্ধা নেমে এসেছে। রাস্তায় সড়কবাতির আবছায়া।—-বাস গুমটির এদিক ওদিক জড়সড় হয়ে বসে আছে অনেকে। রাত বেড়ে চলে। মোয়ির দেখা কি পাব ? বলেছে এখনো অপেক্ষায় আছে ! ঘুম ঘুম চোখ। ঘুমিয়েই পড়ি – যদি মোয়ি এসে পথ দেখায়!আমি যে তার শরীরের গন্ধ পাচ্ছি ! ঘুমিয়ে পড়লেই তো দেখতে পাব মোয়ির গাছ কোমরে জড়ানো শাড়ি, মাথার উপর চূড়া খোঁপা শক্ত করে বাঁধা টান টান শরীর ! বেঞ্চে বসে এদিক ওদিক করি। কিন্তু ঘুমোতে পারছি না । ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। মোয়ির প্রতিক্ষায় থেকেও ঘুমোতে তো পারলাম না ! মোয়ি এলো না পথ দেখাতে!অভিমান করেছে ?——–
“দু চারটে খালি পাতার পরে কিছু লিপিবদ্ধ শব্দ—”
–।১০।২০১৭
নেত্রকোনা পৌঁছেছি দিন কয়েক আগে। বেশ কিছু জায়গা ঘোরাঘুরি করে অনুভব করি এখানকার আকাশবাতাসে যেন পরিচিতির গন্ধ। আজ রাতের খাওয়ার টেবিলে মাথায় সাদা ফেজ,বলী কুঞ্চিত মুখে সাদা ধবধবে দাড়ি এক বৃদ্ধের সাথে আলাপে কিছু সূত্র পেলাম। সারা শরীরে বিদ্যুৎ তরঙ্গের আলোড়নে দিশেহারা বোধ করি। জানলাম নদীর ধারে পাহাড় এই অঞ্চলেই আছে। চীনা মাটির পাহাড় – স্থানীয়রা বলে সাদা পাহাড়। সোমেশ্বরীর স্রোত নাকি সেই পাহাড় প্রায় স্পর্শ করে বয়ে চলেছে। স্তব্ধ হয়ে কতক্ষন বসেছিলাম জানি না। মোয়ির সংকেত কি সত্যি হতে চলেছে ! মরিচিকা ?? হুঁস ফিরলে দেখি বৃদ্ধ কখন উঠে চলে গেছেন। বেসামাল আমি হোটেলের বাইরে গিয়ে তাঁর দেখা পেলাম না। হোটেলের লোকদের জিজ্ঞাসা করে জানতে পারি – বৃদ্ধ প্রায় রোজ রাতেই এই হোটেলে খেতে আসেন। কাছেই ওনার মুদির দোকান। আমার হাবভাবে এরা বোধহয় বিস্মিত হয়েছেন। বৃদ্ধকে কাল খুঁজে বের করতেই হবে।
হোটেলের ঘরে মোমবাতির আলোয় বসে আছি – হোটেল এলাকায় বিদ্যুত বিভ্রাট। ঘরের এক ফালি জানালা দিয়ে রাতের টুকরো আকাশ দেখা যায়। কখন আধো ঘুমে আচ্ছন্ন হয়েছি। নতুন দৃশ্য ভেসে ওঠে স্বপ্নে। জলের ওপর জমে থাকা সন্ধ্যার কুয়াশায় দোদুল্যমান নৌকার হালে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছি।হঠাৎ মাথায় ভারি কিছুর প্রচন্ড আঘাতে হেলে পড়ছি নদীর জলে, শরীরে ঠান্ডার আভাস – শেষ মুহূর্তে চোখের সামনে ভেসে ওঠে আমার পরম বন্ধু জুরুং এর হিংস্র মুখ। ডুবন্ত আমি দুরে কুয়াশার আড়ালে আবছা দেখি অপেক্ষমান মোয়ি । “মোয়ি, মোয়ি” – নিজের গলার শব্দে চমকিত হয়ে স্বপ্ন ভেঙ্গে যায় – মাথায় পরিচিত তীব্র যন্ত্রনার রেশ । জানালায় উঁকি দিচ্ছে ভোরের আকাশ। কখন সকাল হয়ে গেল! টের পাইনি। বৃদ্ধের খোঁজে বেরতে হবে।
আবার কিছু সাদা পাতা —–
–।১০।২০১৭
বৃদ্ধের খোঁজ পেলাম। সকালে সবে তাঁর এক চিলতে দোকান খুলে বসেছেন। আমার কথা শুনে আর মুখের চেহারা দেখে তাঁর বুঝি দয়া হলো। বললেন নদী পাহাড় দেখতে হ’লে যেতে হবে বিরিশিরি । এখান থেকে যাতায়াতের জন্য কিছুই তো নেই। চিন্তিত হয়ে বলেন “–তবে একটা উপায় আছে – ছেলেকে বলব তার মোটর বাইকে আপনাকে বিরিশিরি পৌঁছে দিতে।“ ওনাকে সালাম জানিয়ে ফিরে এলাম।
–।১০।২০১৭
বিরিশিরি পৌঁছেচি। হেমন্তের পরশ আকাশে বাতাসে। অনুভবে বুঝি এযেন আমার কতকালের পরিচিত জায়গা। আত্মার টান অনুভব করি। নিজের জায়গায় পৌঁছনোর এক প্রগাড় নিশ্চিন্ততা শরীর মন ভরিয়ে দিয়েছে । নদীর কাছেই ছোট্ট হোটেলে উঠেছি। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পৌঁছে গেছি নদীর ধারে । ওপারে দেখি সাদাটে ধূসর টিলা শ্রেনী – ওই কি সাদা পাহাড় ?
একটি না লেখা পাতার পর –
–।১০।২০১৭
জনবসতি অনেকটা পিছনে ফেলে, বিরিশিরি শহরের শেষ প্রান্তে নদীর নীল জলে পা ডুবিয়ে বসেছিলাম আজ সন্ধ্যা নামার আগে। দক্ষিণায়নের অস্তরাগে আকাশের স্বর্ণালী প্রতিবিম্ব নদীর নীল জলে হোলি খেলে, জলের মাঝে একফালি সোনালী বালুচর। নদীর ওপারে ধুসর সাদাটে টিলা ছুঁয়ে হেমন্তের ক্ষীণস্রোতা সোমেশ্বরী বয়ে চলেছে। নিজের আপন জায়গায় বসে থাকার অবাধ ভালো লাগার অলস আবেশে।
নিজের অজান্তে চোথদুটো কখন যেন ক্রমশ ঢাকা পড়ে যায় অদৃশ্য আস্তরণে –আঁধারে ঢেকে যায় বিশ্ব চরাচর – সাথে সাথে লুপ্ত হয় বর্তমান। মানস পটে ক্রমশ ভেসে ওঠে অস্তরাগের রঙে ছোঁয়া আকাশ বাতাস, নীলচে সবুজ নদীর জল । ধিরে নেমে আসে সন্ধ্যার আলোছায়া। ওপারে ঝাপসা ধূসর সাদা টিলা শ্রেনী। কিছু দুরে জলের ধার ঘেঁসে নল খাগড়ার ঝোপ । অতি কাছের কারুর নিকট হওয়ার উৎফুল্লতায় মনটা ভরে উঠেছে। গাড় প্রশান্তির অনুভূতি সারা শরীরে । সন্ধ্যা নেমে আসা আকাশের কালচে নীলের আলোছায়া নদীর জলে। হঠাৎ দেখা যায় হাওয়া ভাসা কুয়াশার ধূসর ওড়না জড়িয়ে – ধিরে, অতি ধিরে আবির্ভুত হয় এক ডিঙ্গি নৌকার জলে ভেজা কালচে অবয়ব – কুয়াশার অন্তরালে ডিঙ্গি ভেসে যায় নলখাগড়ার ঝোপের আড়ালে – শুনতে পাই, বাতাসে ভেষে আসা অতি চেনা মিষ্টি গানের সুর – এতো আমার ভাষা, গারো মান্দি ভাষায় গান! অতি পরিচিত কন্ঠ স্বর – মোয়ির চিরাচরিত আমন্ত্রনের ডাক — কাছে আসার আহ্বান। মোয়ি এসেছে —- অনেক কাল আগের মত গানের সুরে সে আমায় কাছে ডাকছে। আমি পেয়ে গেছি আমার জন্মজন্মান্তরের সাথি মোয়িকে। জলে নেমে দ্রুত এগোই নলখাগড়ার ঝোপের আড়ালে। দিনের কাজের শেষে আমাদের মিলিত হওয়ার পরিচিত স্থান । মোয়ির উপস্থিতির রেশ ছড়িয়ে রয়েছে শরীরে মনে।
জলের ওপর অন্ধকার নেমে এসেছে। দু হাত সামনে বাড়িয়ে এগিয়ে যাই। ডিঙ্গির ছোঁয়া তো পেলাম না ? গানও থেমে গেছে। হঠাৎ অনুভব করি মাথায় অসহ্য যন্ত্রনা– শরীর হল অবশ। বেশ কিছু পরে হুঁস ফেরে ঠান্ডা পরশে। নিজেকে দেখি জলে ভিজে দাঁড়িয়ে আছি নদীর পারে।
হতাশ হয়ে ফিরে এসেছি আমার ছোট্ট আস্তানায়। সুজয় বলেছিল সব লিখে রাখতে।
এক পৃষ্ঠা পর —–
–।১০।২০১৭
এখন রাত অনেক। কেন ফিরে এলাম ? মাথায় যেন কোন পুরোনো অসহ্য যন্ত্রনার স্মৃতি জানান দেয়।গানের মন কেমন করা সুরের ভিতর দিয়ে কাছে আসার আহ্বান আবার বাতাসে ভাসে, আহ্বানের সুর তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে—- মোয়ি এখনো অপেক্ষায় আছে । এত দিন অপেক্ষায় থেকে –আজ সন্ধ্যায় বোধহয় অভিমানে ডিঙ্গি সরিয়ে নিয়েছিল জলের গভীরে !! ওই তো সেই আকুল করা সুর। না: এখুনি না গেলে মোয়ি অভিমান করে চিরতরে হারিয়ে যাবে —আমি জানি। মোয়ি – দাঁড়াও -আমি এখুনি আসছি—–
আর কোনো লেখা নেই —– গভীর আনমনায় ডায়রী বন্ধ করে চেয়ে থাকি ঘরের জানালা দিয়ে শহরের ধোঁয়া মিশ্রিত সন্ধ্যায়।
ধূর্জটি এখন কোথায় !! রহস্য রয়ে গেল —-সত্যি কি সে খোঁজ পেল মোয়ির?