Home Choto Golpo শেষ কিস্তি

শেষ কিস্তি

1530
0
-Advertisement-

শেষ কিস্তি

ভাস্করবাবু অবসর নিলেন।দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছর সরকারের হরেক বিভাগে কাজ করে, এখন তাঁর অফুরন্ত সময়, কিন্তু মনের ভেতর চিন্তা – এই সম্পূর্ন নতুন জীবন অনেকটা অচেনা জলে সাঁতারানোর মত।আবার ভাবেন সত্যি কি এই অবসর নির্বিঘ্ন ?  হয়ত জীবনের অন্যান্য অধ্যায় গুলির মত আর একটি নতুন অধ্যায় শুরুর আগে সবাইকেই দোদুল্যমান অনিশ্চয়তার সন্মুখীন হতে হয়।।

নিজের শখগুলো এতদিন মেটাতে পারেননি। তাঁর পান সিগারেটের নেশা বা অন্য কোনো বদঅভ্যাস নেই। তবে তাস দাবা আর পাশা – এই তিন নেশার দ্বিতীয়টি তাঁর ভালোমত ছিল।বত্রিশ ঘুঁটি আর চৌষট্টি ছকের চৌখুপির মধ্যে তাঁর চিন্তা, ভাবনা, স্বপ্ন আবর্তিত হত।সুদুর অতীতের কলেজ জীবনে কিছু নামও করেছিলেন। অফিসে থাকাকালীন, ছুটিছাটায় পাড়ার একটি পাঠাগারে মাঝে মাঝে সময় কাটাতেন বিশেষ কয়েকজনের সাথে দাবা যুদ্ধে।

 পরবর্তি জীবনে অফিসের, সংসারের, ছেলেকে দাঁড় করানোর চেষ্টা ইত্যাদিতে বছর গুলো কেটে গেছে । তার ওপর মধুছন্দা , তাঁর স্ত্রী আজ ছয় মাস শয্যাশায়ী।যদিও তার শরীর কে দোষ দেওয়া অন্যায় হবে। তিনি দোষ দেন না। ভেবেছিলেন ওই দ্বিতীয় নেশাটি নিয়ে সময় কাটাবেন। কিন্তু বিনা মেঘে বজ্রাঘাত কি বস্তু তিনি বুঝলেন যখন অবসরের কয়েকমাস পর মধুছন্দার দেখাশোনার সর্বক্ষণের মেয়েটি হঠাৎ কাজে জবাব দিল।

এখন দেখেন তাঁর চারপাশে কেউ নেই – তিনি একা।একমাত্র ছেলে কর্মজীবনের শুরু থেকে বিদেশে জীবনে দাঁড়ানোর পথে ব্যাস্ত। স্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা, ভালোবাসা ও কর্ত্তব্য বোধে তিনি নিজের হাতে সব কাজ তুলে নিয়েছেন। একটি কাজের ছেলে, কেদার তাঁকে সাহায্য করে।

স্ত্রীর দেখাশোনার দরুন বেশী বেরোতে পারেন না ।তিনি বন্ধুবৎসল।এখন পাড়ার ক্লাবে যেতে পারেন না। তাই পৈত্রিক বাড়ির নিচের তলায় রাস্তা ঘেঁসা একটি বড় ঘর তিনি ঘুছিয়ে নিয়েছিলেন সান্ধ্য বৈঠকের জন্য।সেখানে পাড়ার দাবাড়ুদের আর খেলা দেখার উৎসাহীদের ছিল অবারিত দ্বার। রোজকার আতিথ্যের কোন খামতি ছিল না।বেশ কি়ছু দাবার সরঞ্জামের ব্যাবস্থাও করেছিলেন বন্ধুদের জন্য। দিনের বেলা একা একাই দাবার ছকে ব্যস্ত থাকেন-সঙ্গে থাকে বিখ্যাত দাবাড়ু ববি ফিশারের “Bobby Fischer Teaches Chess” বইটি, যা ছিল তাঁর ভাগবত গীতা।

ঠিক সন্ধে সাতটায় ঘরের রাস্তার দিকের দরজা খুলে দেয় কাজের লোক কেদার, চা কফির ব্যবস্থা পর্যাপ্ত । একটা টিভিও রেখেছিলেন বন্ধুদের জন্য। কোনো অসুবিধা নেই। ভাস্করবাবু স্ত্রীর সায়াহ্নকালীন তত্বাবধান সেরে ঠিক সাড়েসাতটায় নেমে আসেন দাবার আড্ডায় – রুটিনের কোনো পরিবর্তন নেই।শুধু তিনি যেন একটু চুপচাপ হয়ে গেছেন। সবাইকে নি:শব্দে স্বাগত জানিয়ে – বসে পড়েন বিশাল ঘরের এক কোনায় তাঁর নির্দিষ্ট দাবার ছকের সামনে।আগে যে কেউ তাঁর অপর দিকে বসে পড়ত কিন্তু এক দু দান খেলে প্রতিটিতেই পাঁচ ছয় চালে গোহারান মাত হয়ে যেত।তাঁকে সবাই দাবার বিশেষজ্ঞের তকমা দিয়েছিল।এই ঘরটির ওপরের ঘর থেকে মাঝে মাঝে ক্ষীণ পায়ে চলার শব্দ পেলেই, তিনি সবকিছু ছেড়ে সিঁড়ির দিকে দ্রুত চলে যান।আবার কিছু সময়ের পর ফিরে এসে দাবার ছকে বিভোর হয়ে পড়েন। আশ্চর্যের ব্যাপার হল – আমরা সব সময় পায়ে চলার অত ক্ষীণ শব্দ শুনতে পেতাম না কিন্তু ভাস্করবাবু যতই খেলাতে মগ্ন থাকুন না কেন,ঘরে কথাবার্তার আওয়াজ যাই হোক, তিনি ঠিক শুনতে পেয়ে নি:শব্দে উঠে চলে যেতেন। আমাদের কৌতুহল মিটে গিয়ে দু:খ হয়েছিল যখন সতীশ পাড়ার ডাক্তারের কম্পাউন্ডারের কাছে শুনেছে ভাস্করবাবুর স্ত্রী জটিল স্মৃতিভ্রংশ রোগে ভুগছেন।ডাক্তাররা জবাব দিয়েছেন।

এই ভাবেই তাঁর চলে যাচ্ছিল।কিন্তু সবার অলক্ষ্যে তাঁর চরিত্রের কিছু পরিবর্তন হতে থাকে।ক্রমশ বন্ধুরা টের পেতে থাকে ভাস্করবাবুর ব্যবহারে বৈসাদৃশ্যের ক্ষীণ আভাস, তাঁর চরিত্রের এই বৈপরীতা বন্ধুদের অবাক করেছিল কিন্তু তাঁর রোজকার স্বাভাবিক উদার আতিথেয়তায় কখনো তারা স্বাচ্ছন্দের অভাব বোধ করেনি ।তাঁর ব্যাবহারে এখন দেখা যায় সামান্য রুক্ষতার ছোঁয়া।সাধারনত: পোশাকআসাকে পরিপাটি থাকতেন কিন্তু এখন দেখা যায় তাঁর সে দিকে বিশেষ নজর নেই। খই ফোটা না কামানো দাড়ি। বিশেষ বাক্যালাপ করেন না, একেবারেই নির্লিপ্ত গম্ভীর। আজকাল দাবা সন্মন্ধীয় কথা ছাড়া অন্য কথা ঠিক পছন্দ করেন না। দাম্ভিকতার ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। স্ত্রীর শরীরের খবর জানতে চাইলে – অন্যমনস্ক চাউনি তে এড়িয়ে যান।দাবা খেলায় পাকা খেলোয়াড় না পেলে তিনি একাই দাবা খেলেন –ঘন্টার পর ঘন্টা। আজকাল রাতে সবাই চলে যাওয়ার সময় দেখে – ভাস্করবাবুর স্থির চোখ দাবার ছকে নিবদ্ধ কোনদিকে হুঁস নেই। তাঁর সর্বক্ষণের প্রিয় সঙ্গী বইটি খুলে মাঝে মাঝে দেখেন আর চাল প্রতিচাল দিয়ে যান একাই। মাঝরাত কখন পেরিয়ে যায় খেয়াল থাকে না।

 উনি বিশেষত দুজনের জন্য অপেক্ষায় থাকেন।পাড়ার সজলবাবু আর নরেন বাবু।পাড়ার একমাত্র এঁরা দুজন টানা দশ খেপ খেলায় হয়ত একবার ভাস্কর বাবুকে মাত করতে পারতেন।কোন দিন এই দুজনের কেউ যদি আড্ডায় না আসতেন – ভাস্করবাবু কে দেখা যেত নিজের নির্দিষ্ট চেয়ারে বসে তাঁর সেই বইটা খুলে নি:শব্দে একাই ঘুঁটি চালাচালি করতে।তিনি অন্য কারুকে ঠিক খেলার যোগ্য মনে করতেন না – বোধহয় তাচ্ছিল্য করতেন।

এই ভাবেই চলছিল।

সে দিন পাড়ার সতীশ তার এক দুরসম্পর্কের ভাই কে নিয়ে আড্ডায় এসে হাজির। ছেলেটির নাম সঞ্জয়।সে নতুন চাকরী পেয়ে কোলকাতায় এসেছে। ছিপছিপে লম্বা খেলোয়াড়ি চেহারা, বেশ চালাক চতুর, সপ্রতিভ। সে চোখেমুখে কথা বলে কিন্তু বাতুলতার দোষ কেউ দিতে পারবে না ।কথাবার্তা ছিল বেশ বুদ্ধিদীপ্ত।অল্প কিছুক্ষণে সবাই বুঝে যায় ছেলেটির অনেক বিষয়ে গভীর জ্ঞান আর যে কোনো প্রশ্নের চটজলদি উত্তর তার ঠোঁটে সবসময় হাজির।কথাবার্তায় বড়ই পটু। সবাইকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখার ক্ষমতা রাখে।সঞ্জয় যেদিন প্রথম আসে, ভাস্করবাবুর সঙ্গে তখনো তার আলাপ হয়নি।সে দিন বেশ দেরীতে ভাস্করবাবু ঘরে এসে যথারীতি সজলবাবু, নরেনবাবুর খোঁজ করাতে, সতীশ বললো “  আরে জানেন না ?  আজ সকালে সজলবাবু অফিসের কাজে দিল্লী গেছেন, কবে ফিরবেন বলে যান নি আর নরেনবাবু তো কদিন জ্বরে ভুগছেন, এক হপ্তার আগে বাড়ি থেকে বেরোতে পারবেন বলে মনে হয় না। অভ্যাসমত সবার কুশল জিজ্ঞাসা করে ভাস্করবাবু হতাশ হয়ে গম্ভীর মুখে নিজের চেয়ারে বসে সেই বইটা বার করে দাবার ছকে সৈন্যসামন্তের বূ্হ্য সাজাতে থাকেন।

 ভাস্করবাবু ঘরে আসার পরই নতুন চেনা সঞ্জয়ের সঙ্গে আমাদের তুমুল আড্ডায় সাময়িক ছেদ পড়েছিল। খেয়াল করি তার কৌতুহলী দৃষ্টি অনুসরণ করছে ভাস্করবাবুর গতিবিধি।তখন মৃদুস্বরে ভাস্করবাবুর পরিচয় সবিস্তারে বলে তার কৌতুহল মেটানোর চেষ্টা করে যোগ করি “ উনি এই মহল্লার সব থেকে বড় খেলোয়াড়, দাবা ওনার জীবনের ধ্যান জ্ঞান,  ছকের অলিগলি সব তাঁর নখদর্পণে – আজ অবধি কেউ হারাতে পারেনি – সজলবাবু নরেনবাবু মাঝে মাঝে চেষ্টা করেন বটে, তবে বড়জোর একবার কি দুবার সফল হয়েছেন। আর আমরা এখানে কেউই পাঁচ ছয় চালের বেশী টিকতে পারিনি।এখন তো উনি ওই দুজন ছাড়া আর কারুকে তাঁর সাথে খেলার যোগ্য মনে করেন না।”  সে ভাস্করবাবুর থেকে দৃষ্টি না ফিরিয়ে কি ভেবে হঠাৎ উঠে তাঁর টেবিলের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে “ ওনার সাথে একটু আলাপ করে আসি।”

 সঞ্জয় ওনার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে পেছনে হাত রেখে মনযোগ সহকারে তাঁর ঘুঁটি সাজানো দেখতে থাকে। ভাস্করবাবু একবার মাথা তুলে ভ্রু কুঁচকে সঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে আবার দাবার ছকে মনোনিবেশ করলেন।

সঞ্জয় এবার গলা ঝেড়ে নিয়ে বলে “ নমস্কার –আপনার এখানে প্রথম বার এলাম – খুব ভালো লাগছে আপনার এত সুন্দর ব্যবস্থাদি দেখে। তুলনা নেই। সবাই আপনার খেলার কত প্রশংসা করছে।”  একটু থেমে যেন মিনতি করে –“ যদি অনুমতি দেন- আপনার সাথে এক দান খেলতে পারি ?”

ভাস্করবাবু ধিরে ধিরে ছক থেকে বিরক্তি ভরা চোখ তুলে তার আগাপাশতলায় দৃষ্টি বুলিয়ে বলেন “ দেখ ভায়া – আমি খুশী হয়েছি তুমি আজ আমার এখানে প্রথমবার এসেছ।তোমায় চা কফি দিয়েছে তো ?” এরপর কাজের ছেলে কেদারের দিকে ফিরে বলেন “ এই বাবু প্রথমবার এখানে এসেছেন – ঠিক করে যত্নআত্তি করবি।”  আবার সঞ্জয়ের দিকে ফেরেন “ দেখ বাপু – আমি এখানে কাউকে দাবা খেলা শেখাই না। তুমি বরং এদের কারুর সাথে খেলাটা অভ্যাস করতে পার ।” আবার ওনার চোখ ঘুরে যায় সাজানো দাবার ছকে।

সঞ্জয় আর কিছু না বলে – ভাস্করবাবুর নিজের সাথে খেলা আরম্ভের দিকে তাকিয়ে থাকে। আমাদের গল্পগুজবে ইতি পড়েছে। অনেক সময় নিয়ে ভাস্করবাবু নিজের প্রথম চালটি যেই দিয়েছেন – সঞ্জয়ের গলার আওয়াজে সবাই চমকে উঠি –“ কিছু মনে করবেন না স্যার,  আমি হলে খেলা আরম্ভ করতাম Ruy Lopez পদ্ধতিতে।” নির্বিকার মুখে বলে ওঠে সে।

লক্ষ্য করি ভাস্করবাবুর মুখচোখ লাল হয়ে উঠছে । ধিরে ধিরে তাকান সঞ্জয়ের দিকে – “ তুমি দাবা খেলতে জান !!” একটু আশ্চর্যের সুর গলায়,  অবজ্ঞার ছোঁয়াও আছে । পর মুহূর্ত্তে শুনি অল্প খুশীর ভাব “ বসে পড় ভায়া – এক দান হয়ে যাক। তার বেশী হয়ত সামলাতে পারবেনা”   আমরা সবাই একযোগে পৌঁছই ভাস্করবাবুর টেবিলে। নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করি – সঞ্জয় বেশী পাকামি করতে গিয়ে এবার নাস্তানুবাদ হতে যাচ্ছে – ওপর চালাকির একটা সীমা থাকা উচিত। 

ভাস্করবাবুর আর সঞ্জয়ের খেলা আরম্ভ হয়ে যায়। আমরা টেবিলের চারিদিক ঘিরে দাঁড়িয়ে।ভাবি সঞ্জয় ছেলেটি বড় বেশী পাকা – এবার বুঝবে। ওর হাবভাব দেখে, খেলতে বসেছে বলে মনে হয় না — আবার মহল্লার শ্রেষ্ঠ দাবাড়ু ভাস্করবাবুর সাথে !!  নিজেদের মধ্যে গা ঠেলাঠেলি করি – দ্যাখ, ছেলেটা খেলতে বসেছে বলে মনেই হচ্ছে না ! তার প্রথম চালের পরই – সে ঘুরে বসে আমাদের দিকে –  আগের আড্ডার রেশ ধরে কথার তুবড়ি ছোটাতে শুরু করে – দাবার ছকে মনই নেই – সে দিকে ফিরেই তাকাচ্ছে না – ছি ছি ! নিজের সাথে সতীশের মুখটাও পোড়ালে দেখছি !ওদিকে ভাস্করবাবু মিনিট দশেক ভেবে তাঁর দ্বিতীয় চাল দিতে না দিতেই সঞ্জয় ছকের দিকে ফিরে বসে – মুহূর্ত্তের মধ্যে, ছকে একবার চোখ বুলিষেই নিজের চাল দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে বসে আমাদের দিকে – শুরু করে তার কথার পিঠে কথার ফুলঝুরি,  কি না বলে যাচ্ছে – ঈস্টবেঙ্গল মোহনবাগানের খেলা নিয়ে মন্তব্য, নতুন কি একটা সিনেমার সমালোচনা ইত্যাদি।খেলার দিক মনই নেই। একটা খেপ শেষ হতে না হতেই ভাস্করবাবুর আর্তনাদ “ আর একটা হোক”–   ভাস্করবাবু বেশ ভেবে চিন্তে দশ পনেরো মিনিট পর এক একটা চাল দেন আর সঞ্জয় তার কথার তুবড়ি মুহূর্ত্তের জন্য না থামিয়ে – একবার ছকে চোখ বুলিয়েই, তার নিরবচ্ছিন্ন কথার তোড়ের মাঝেই নিজের চাল দিয়ে, পিছন ফিরে আমাদের সঙ্গে গল্পে মশগুল হয়ে যায়। এইভাবে চলে পাঁচ পাঁচটা খেপ। শেষে খেলার ফল দেখি – অবিশ্বাস্য, ভাস্করবাবু পাঁচটা খেলাতেই মাত হয়ে গেছেন সঞ্জয়ের কাছে।

তখন বেশ রাত হয়ে গেছে। সবাই একে একে বাড়ির পথ ধরে।সতীশ সব শেষে বেরনোর সময় দেখে – ভাস্করবাবু দাবার ছকে চোখ রেখে – হতোদ্যমের  আচ্ছন্নতায় নিশ্চুপ বসে আছেন ।

কেদার কে সব বন্ধ করার নির্দেশ দিয়ে, ভাস্করবাবু মন্থর পায়ে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ান।তাঁর মাথায় যেন কিসের অসহ্য ভার-ওই বাচ্ছা ছেলেটা খেলার ছলে তাঁর এতদিনের নিবিড় অধ্যাবসায়, খেলার দক্ষতা – সব যেন ফুৎকারে উড়িয়ে দিল অবলীলায়। মেনে নিতে পারছেন না।মানসিকভাবে তিনি দেউলিয়া হয়ে গেছেন।

স্ত্রীর ঘরে হালকা নীলাভ রাত বাতির আলোআঁধারি। দুরারোগ্য স্মৃতিভ্রংশের মারণ রোগে আক্রান্ত মধুছন্দার শরীর যেন বিছানায় মিশে আছে। একটু ঝুঁকে দেখেন অনুভূতিহীণ নির্নিমেষ দৃষ্টি, ভাবলেশহীণ ফ্যাকাশে মুখে পরিচিতির প্রকাশ নেই। ডাক্তার জবাব দিয়েছেন, তবুও সপ্তাহে একবার আসেন।তাঁর এখন অপেক্ষার পালা।

“ ঘুমিয়ে পড় মধুছন্দা – আমি আছি, নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়।”  কোন সাড় নেই – তাঁর নিজের ঘুম বহু দিন আগেই শেষ হয়ে গেছে।

ভাস্করবাবু ছাদে উঠে আসেন – শিব চতুর্দশী তিথির এক ফালি নির্জীব চাঁদ প্রশস্ত আকাশে ভাসছে। কোথায় শুনেছিলেন এই তিথিতে নতুনের আগমনে মনের তমশার বিনাশ ঘটে । কিন্তু তাঁর অনুভূতিতে কেন অন্ধ জিগীসার তীব্রতা ? ময়াল সাপের মত পাকে পাকে তাঁকে নিস্পেসিত করছে।তাঁর এতদিনের ধ্যান জ্ঞান অধ্যাবসায় ধুলোয় মিশিয়ে, আত্মবিশ্বাসের ভিত্তিটাকে এক ধাক্কায় বীর্যহীন করে দিয়ে গেল বাচ্ছা ছেলেটা – এত বড় অপমান মেনে নিতে পারছেন না ভাস্করবাবু।

পরের দিন একটু আগেই ভাস্করবাবু নিচের ঘরে এসে তাঁর চেয়ারে বসে গভীর মনযোগে সেই বইটার পাতা ওল্টাতে থাকেন। মাঝে মাঝে খেয়াল রাখেন কখন সেই সঞ্জয় নামে ভুঁইফোড় ছেলেটা সতীশের সঙ্গে ঘরে আসে। আজ তিনি আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। আজ নিজেই ছেলেটাকে ডাকবেন খেলার টেবিলে। হৃতসম্মান পুনরুদ্ধার করতে আজ তাঁকে জিততেই হবে।

সঞ্জয় একটু পরেই তার নিজস্ব পরোয়াহীণ চালে,  কোন সিনেমার গানের কলি ভাঁজতে ভাঁজতে সতীশের সঙ্গে ঘরে ঢোকে।সবাইকে অবাক করে, ভাস্করবাবু যেন কেমন তড়িঘড়ি তার হাত শক্ত করে ধরে টেনে নিয়ে আসেন তাঁর সযত্নে সাজানো দাবার ছকের টেবিলে।তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ এহেন ব্যবহারে সবাই আশ্চর্য্য হয়।তিনি একটু চিবিয়ে চিবিয়ে বলেন “ এস ভায়া, আজ তোমার কেরামতিটা একটু দেখা যাক, আজকের জন্য  তিনটে খেপ যথেষ্ঠ হবে বলে মনে হয়, কি বলো ?” সঞ্জয় যেন জোর করে নিজের প্রাথমিক হতভম্বতা কাটিয়ে “ হ্যাঁ হ্যাঁ –  যখন বলছেন, চেষ্টা করব আজকেও আপনাকে খেলার আনন্দ দেওয়ার।”  আমরাও আবার টেবিলের চারপাশে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি। আশ্চর্য আশ্চর্য –  খেলার সময় সঞ্জয়ের আবার সেই অদ্ভুত অখেলোয়াড়িচিত ভাবভঙ্গী, নানা গল্পের তুবড়ি – আপাতদৃষ্টিতে এই বুদ্ধির খেলাকে তার গুরুত্ব না দেওয়া আর অপর দিকে ভাস্করবাবুর সর্বস্ব না হারানোর পণে দৃড়প্রতিজ্ঞ ভাব। ভাস্করবাবু পর পর তিন খেপ হেরে গেলেন।

এরপরের মুহূর্ত্ত অবিশ্বাস্য। ভাস্করবাবু উন্মত্ত রাগে এক ঝটকায় দাবার ছক, ঘুঁটি টেবিল থেকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে- রক্তচক্ষুতে তাকিয়ে থাকেন সঞ্জয়ের দিকে। তাঁর শরীর থরথর করে কাঁপছে। পর মুহূর্ত্তে গভীর অবসন্নতায় কোনক্রমে টেবিল ধরে বসে পড়েন চেয়ারে।মুখে চোখে নি:শ্বতা,  সর্বস্ব হারানোয় ভেঙ্গে পড়া একজন মানুষ। সেই গর্বিত দৃষ্টি কোথায় মিলিয়ে গেছে। গল্প গুজবে ভরে থাকা ঘরে এখন শ্বশানের নিস্তব্ধতা। সঞ্জয় ঘটনার গুরুত্ব বুঝতে না পেরে বাইরে চলে যায়।

এরপর ভাস্করবাবু একটু ধাতস্থ হয়ে তাঁর বইটা তুলে মাথা নিচু করে অবসন্ন পায় বাড়ির ভেতরে চলে যান। সেদিনের মত দাবার আড্ডাটা ভেঙ্গে গেল।

ভাস্করবাবু সে দিনের পর সাত সাতটা দিন নিচে নামেন নি।কেদার কে দিয়ে বলে পাঠিয়ে ছিলেন, তাঁর শরীরটা একটু খারাপ, কদিন নিচে নামতে পারছেন না –

সে দিন সন্ধ্যেবেলা এসে দেখি ভাস্করবাবু যথারিতি তাঁর চেয়ারে বসে দাবা সাজিয়ে,বইটির পাতা ওল্টাচ্ছেন। আমাদের দেখে মাছের মত চোখে সঞ্জয়ে খোঁজ করেন। একটুপরে দেখা গেল নরেনবাবু সজলবাবু দুজনেই এসে হাজির।ভাস্করবাবু তাঁদের দেখে উচ্ছসিত হয়ে উঠলেন। তাঁদের স্বাগত জানিয়ে, একটু তাড়াহুড়ো করে বলেন “ তোমরা এক সঙ্গে কোথায় গায়েব হয়ে গেলে বলতো ? খেলার লোক পাওয়া মুশকিল হয়ে গেছে হে । তা নরেনবাবু বসে পড়ুন –দু তিন খেপ হয়ে যাক ।” কথা বলার সময় মনে হল – তাঁর অস্বাভাবিক উজ্জল হয়ে ওঠা চোখ দুটো আর কাউকে খুঁজে বেড়াচ্ছে । বোধহল সঞ্জয়কেই খুঁজচ্ছেন। নরেনবাবু সজলবাবু – দুজনেই যেন হতচকিত। তাঁরা বুঝতে পারছেন না ভাস্করবাবুর অস্বাভিকতার কারণ।

আগের মত ঝকমকে দৃষ্টি ।ভাস্করবাবু মহা উৎসাহে নরেনবাবুকে অপর চেয়ারে বসিয়ে, দু হাত পরস্পরে ঘসে – আরম্ভ করলেন দান দেওয়া।

পর পর তিন দান হেরে গেলেন ভাস্করবাবু- যিনি কাউকে নিজের সমকক্ষ হিসেবে মনে করেন নি কখনো । সেই দাম্ভিক ভাস্করবাবু মাত হয়ে গেলেন নরেনবাবুর কাছে, পর পর তিন খেপ। যিনি দশটা খেলায় হয়ত কোনক্রমে এক খেপ হারাতে পারতেন ভাস্করবাবুকে সেই নরেনবাবু অবাক চোখে তাকিয়ে থাকেন। আমাদের অবস্থা তথৈবচ।

স্তুম্ভিত ভাস্করবাবু দাবার ছকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে বসে থাকেন । কি মনে করে, এবার স্খলিত স্বরে এবার প্রায় মিনতি করেন সজলবাবুকে তাঁর অপর দিকে বসতে। কিমআশ্চর্যম – প্রথম খেপেই মাত্র দশ এগারো চালে মাত হয়ে গেলেন ভাস্করবাবু। এখন যেন বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত ভাস্করবাবুর মরা মাছের মত চোখ আবার ঘুরে বেড়ায় ঘরে উপস্থিত সবার উপর। মৃদু স্বরে সঞ্জয়ের খোঁজ করেন।

তাঁর চিরসঙ্গী বইটা এবার হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ নিস্পলক চেয়ে থাকেন। অন্যমনশ্ক হাতে একটার পর একটা পাতা উল্টে যান।এবার আমাদের আবার স্তুম্ভিত হওয়ার পালা। তিনি একটার পর একটা পাতা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে বাতাসে উড়িয়ে দিতে থাকেন নিশ্চুপ উন্মত্ত দৃষ্টিতে।

ঘরে পিন পড়লেও শোনা যাওয়ার নিশ্তব্ধতা। আত্মবিশ্বাস তলানিতে পৌঁছনো ভেঙ্গে পড়া স্বরে আবার সঞ্জয়ের খোঁজ করেন ভাস্করবাবু। কিন্তু উত্তরের অপেক্ষা না করে,  টলটলায়মান পায় চলে যান বাড়ির ভেতরে।

আজ আবার ছাদে পায়চারি করেন ভাস্করবাবু। কি যেন খুঁজে বেড়ান অন্ধকার আকাশে।মনে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাওয়ার জ্বালা – অসহ্য যন্ত্রনা। আঘাতে আঘাতে ছিন্নভিন্ন হওয়া মনে চিন্তার ঢেউ ওঠে । তিনি টের পান জয় করার বাসনা পরিবর্ত্তিত হচ্ছে তীব্র জীঘাংসায়। ঝেড়ে ফেলার অদম্য ইচ্ছায় মাথা ঝাঁকান ঘন ঘন । কিন্তু তিনি ব্যর্থ হয়ে ডুবে যান তমসাচ্ছন্ন মনের অতলে।

এরপর কেন জানি না, ভাস্করবাবু আড্ডায় আসা পুরোপুরি বন্ধ করে দিলেন।দাবার আড্ডার দরজাও বন্ধ হয়ে গেল।

আমাদের পাড়ার রাস্তাটা ট্রাম রাস্তায় মিশেছে।বড় রাস্তার মাঝখানে ট্রাম চলাচলের লাইন।ট্রাম থামে ওই মাঝ রাস্তায়। যাত্রীরা ওঠানামা করেন বড় রাস্তার মাঝখানে। তার উল্টো দিকের ফুটপাথের এক চা’য়ের দোকানে আমাদের বিকেলের আড্ডার স্থান বদল হয়। সঞ্জয় এখন পাকাপাকি বাড়ি ভাড়া নিয়েছে এই পাড়াতে।আমরা অফিস ফেরত ওই চায়ের দোকানে বসে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করি – আসলে শুনি সঞ্জয়ের বাকচাতুর্য।ওর কথা শোনা যেন নেশা ধরিয়েছে।

অনেক দিন ভাস্করবাবুর সঙ্গে দেখা হয় নি। সে দিন ছিল শনিবার।অফিস যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়েছি, অনেকদিন পর পথে দেখা তাঁর সঙ্গে।চেহারা একেবারে খারাপ হয়ে গেছে – সেই দাম্ভিক ভাব আর নেই।বড় রাস্তা অবধি একতরফা কথা বলতে বলতে ট্রাম স্টপেজে পৌঁছলাম। মাঝে একবার সঞ্জয়ের কথা জিজ্ঞাসা করলেন।বুঝলাম তাকে তিনি ভুলতে পারেননি।ওনার স্ত্রীর শরীরের অবস্থা এড়িয়ে গেলেন। আমার সঙ্গে একই ট্রামে উঠলেন।

 দুপুরে ছুটির পর বাড়ি আসার পথে বড় রাস্তার চা’এর দোকানে দেখি সতীশ আর দু একজন বসে আছে। সতীশ বলে সঞ্জয় যে কোন সময় অফিস থেকে ফিরবে।দুজনের কোনো সিনেমা যাওয়ার পরিকল্পনা আছে। কিছুক্ষণ গল্প করার পর – একটা ট্রাম এগিয়ে আসছে দেখি আমাদের সামনের স্টপেজের দিকে। দুপুরবেলা – বেশ জোরে ঘন্টা বাজিয়ে আসছে। আমরা গল্প করতে করতে অন্যমনস্ক চোখে তাকিয়ে আছি। একটা বাসও দেখি ট্রামটার পিছনে। স্টপেজের প্রায় পঞ্চাশ ফুট দুরত্ত্বে ট্রামের গতি একটু আস্তে হচ্ছে,  পিছনে আসা বাসের গতি যেন ট্রামটাকে পেরনোর জন্য কিছু বৃদ্ধি পেয়েছে,, হর্ণ বাজিয়ে দ্রুত এগিয়ে আসে – হঠাৎ দেখি ট্রামের খোলা প্রবেশে পথের পাদানী থেকে কেউ ছিটকে ঠিক বাসটার সামনে পড়েই – অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় সার্কাস খেলোয়াড়ের মত ডিগবাজি খেয়ে এক ঝটকায় বাসটার গতিপথের বাইরে গিয়ে পড়ল।বাসটাও ততক্ষণে ব্রেক কষে ট্রাম স্টপেজের প্রায় সামনে এসে থেমেছে।এক নিমেষে ঘটে গেল ঘটনাটা।চতুর্দিক থেকে হই হই করে লোকজন এসে জোটে পড়ে যাওয়া মানুষটির কাছে- সে ততক্ষণে উঠে পড়েছে বড় রাস্তার ফুটপাথে, জামাকাপড়ের ধূলো ঝাড়ছে । আমরা কজনে পৌঁছে গেছি অকুস্থলে।অবিশ্বাসের চমকে দেখি, পড়ে যাওয়া মানুষটি আমাদের সঞ্জয় – মুখে তার স্বভাবগত হাসি লেগে আছে। বলে উঠল “চলো চলো – চা’এর দোকানে একটু বসা যাক।”  ততক্ষণে ট্রামটা পৌঁছে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে চা’এর দোকানের সামনের স্টপেজে। ট্রামের লোকজন দৌড়ে আসে সঞ্জয়ের কাছে।

কিন্তু সঞ্জয়ের যেন কোনো দিকে হুঁশ নেই,। তার তীক্ষ্ণ চোখ স্থির হয়ে আছে ট্রামের প্রথম কামরায়। আমরাও সঞ্জয়ের দৃষ্টি অনুসরণ করি। দেখি ভাস্করবাবু স্খলিত পায়ে ট্রামের পাদানি থেকে নেমে রাস্তা পেরোচ্ছেন।শরীরটা যেন কোনক্রমে টেনে নিয়ে চলেছেন।

সঞ্জয়ের মুখে কৌতুকের হাসি জেগে ওঠে। সে হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে স্যার –   শেষ কিস্তিতেও মাত করতে পারলেন না ?”

-Advertisement-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here