-Advertisement-

                                     সরকার বাড়ির রহস্য

মণিকুন্তলা দেবী গালে হাত রেখে ঘরের ছোট জানলাটার ধারে চিন্তিত হয়ে বসে আছেন। ছোট জানলা দিয়ে অল্প একটু দিনের আলো প্রতিফলিত হয়ে এই ঘুপসি ঘরটায় আসে। হাতে তাঁর রোজকার খরচের হিসেব লেখার একটি ছোট খাতা। তিনি কপালে হাত রাখেন। ক’দিন ধরে মাথাটা কেমন যেন ধরে আছে। এই রোজকার হিসাব লেখা যন্ত্রণা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সারা দিনের দরকারি জিনিসগুলো কমবেশি  করে যে ভাবেই হিসেব করা যাক না কেন,রোজকার বরাদ্দ খরচের মধ্যে কিছুতেই রাখা যাচ্ছে না। পাড়ার মুদির দোকানে ধার বেড়েই চলেছে। চেপে রাখা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। আবার হিসেবটায় চোখ বোলান তিনি – আরে ওইতো! রোজকার ফর্দে একই জিনিস দু’বার লিখে ফেলেছেন! পাঁচটা টাকা খরচ হিসেবে বেশি    দেখানো হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি পাঁচ টাকা বাদ দিয়ে আবার যোগ করেন। না: আজকের ধারের অঙ্কটা কিছু কমলেও, মাসের শেষ দিনের খরচটা রোজের বরাদ্দের থেকে তেমন কমলো না। 

 মণিকুন্তলা দেবীর চেহারায় অতীতের আভিজাত্যর ছাপ কিছুটা হলেও দারিদ্রের যন্ত্রণা পুরোটা কেড়ে নিতে পারেনি। তবে সহজাত বনেদিয়ানার প্রচ্ছন্ন গর্ব এখনো উঁকি দেয় তাঁর হাবেভাবে।

 এখন খরচ সামলানোর চিন্তার অবসন্নতায় আবার হিসেবের খাতায় ঝুঁকে পড়েন তিনি। মাথার যন্ত্রণাটা আজ যেন বেশ বেড়ে গেছে। ঘরের দরজা খোলার শব্দে, চোখ তুলে দেখেন,তাঁর মেয়ে রঞ্জনা এসে দাঁড়িয়েছে। মেয়েকে দেখে তাঁর মনের কষ্টটা যেন বৃদ্ধি পায়। ঘরের অল্প আলোয় মেয়েকে ভালো করে দেখার চেষ্টা করেন। বাইশ বছর বয়স হলো। সত্যিই সুন্দরী,ছিপছিপে শরীর,বংশগত আভিজাত্যর ছোঁয়া অঙ্গে অঙ্গে প্রতিফলিত। কিন্তু কঠোর দারিদ্রের চাপে ম্রিয়মাণ। অনেকটা তাঁর মতনই দেখতে রঞ্জনাকে। তাঁর নিজের ছোটবেলার ছবি মনে পড়ে যায়। এই পরিবেশে রঞ্জনা একেবারেই বেমানান।

“ মা, সকাল থেকে কি করছ বলো দেখি ? সেই এক হিসেব আর হিসেব! সরিয়ে রাখ দেখি তোমার ওই হিসেবের খাতা!”

“ বা রে, পাগলী মেয়ে! দেখতে হবে না হাতের টাকা পয়সার অবস্থাটা কি? কলসি থেকে জমা জল তো বেরিয়েই যাচ্ছে।” দুশ্চিন্তা ঝরে পড়ে মণিকুন্তলার স্বরে।

রঞ্জনা অধৈর্য হয়ে পড়ে  –

“ দেখ মা,এই বাড়িটায় আসা অবধি দেখে আসছি একই অবস্থা। সব সময় আমরা হাতের শেষ পয়সা টুকু গুনে চলেছি। আমাকে কিছু করতেই হবে। উপায় নেই মা।”

“ আমি ভাবছি –”  মণিকুন্তলা দেবী কিছু বলার আগেই, রঞ্জনা থামিয়ে দেয় –

“ না – মা, আমাকে চাকরি খুঁজে বার করতেই হবে।” রঞ্জনা বিক্ষিপ্ত মনে, ছোট্ট ঘরাটায় পায়চারি করতে থাকে।

“খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে। দেখ গ্র্যজুয়েশনের পর কম্পিউটারের কোর্সটা তো করেছি। চাকরি খুঁজতে গিয়ে দেখছি, আমার মতো কত মেয়ে এই কোর্স করেছে – ইন্টারভিউতে প্রথমেই প্রশ্ন করে –

‘আগে কোথায় কাজ করেছো ?

‘এখনো কিছু করিনি –  তবে —’

‘ওহো! অভিজ্ঞতা নেই? – ঠিক আছে, ঠিক আছে , তোমাকে পরে জানাব।’

দিনের পর দিন কেটে যায়। কোনো উত্তর নেই।  আমাকে কাজ যোগাড় করতেই হবে মা, যে করেই হোক।”

“ কেন অত অধৈর্য্য হচ্ছিস তুই? আর একটু অপেক্ষা কর।” মণিকুন্তলা দেবী সান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করেন।

রঞ্জনা ঘরের ছোট জানলার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। তার অন্যমনস্ক দৃষ্টি ঘুরে বেড়ায় সূর্য’র আলো না আসা নোংরা ছড়িয়ে থাকা সরু জলকাদা জমে থাকা গলিতে। রাস্তার বেওয়ারিশ কুকুর বেড়ালদের স্বাচ্ছন্দে ঘোরাফেরা। মশামাছি ভন ভন করা অসাস্থ্যকর পরিবেশ। গলির একপাশে আলো আড়াল করা তিন তলা বাড়িটা, একতলা ঝুপসি বস্তির স্যাঁতস্যাঁতে ঘর গুলির সারিতে। আজকাল এসবে রঞ্জনার মনে কোনো বিকার হয় না।

“মাঝে মাঝে কি মনে হয় জানো মা।” রঞ্জনা বাইরে থেকে চোখ না সরিয়ে ধীরে ধীরে বলে –“ কাবেরী মাসি আমাকে গত শীতে ওদের ব্যাঙ্গালোরের বাড়িতে নিয়ে গেছিল। তোমরা যেতে পারলে না কেন, মনে নেই। খুব আনন্দ করেছিলাম ক’দিন। ভুলেই গেছিলাম এই পরিবেশের ছবি। শহরটা ওরা ঘুরিয়ে দেখিয়েছিল আমায়। জীবনে সত্যি প্রথম এত আনন্দ পেয়েছিলাম, আবার পাব কিনা জানি না। কিন্তু যখন এই পরিবেশটায় আবার ফিরে এলাম, বাস্তবের কঠিন আঘাতে কেমন যেন দিশেহারা বোধ করেছিলাম। মাঝে মাঝে মনে হয় মা, আমি ভুল করেছিলাম কাবেরী মাসির সঙ্গে ব্যাঙ্গালোর গিয়ে।”

এবার রঞ্জনার দৃষ্টি ঘুরে বেড়ায় তাদের ঘরটার ভিতরের চারদিক। মণিকুন্তলা দেবীর অস্বস্তি বেড়ে চলে। তাঁর  চোখ এখন অনুসরণ করে মেয়ের দৃষ্টি। তাঁরও এখন মনে হলো ঠিক এযেন কোনো নিম্নস্তরের বস্তির ঘর।

ধূলোমলিন সস্তা আসবাব, দেওয়ালের স্থানে স্থানে খসে পড়া পলস্তারা, ইঁট বেরিয়ে আছে। ওপরে বাঁশের মাচায় করোগেটের ছাউনি, দেওয়ালে ঝোলানো সস্তা কাঠের তাকে চটা ওঠা কয়েকটা কাপ ডিশ,  পুরনো ছেঁড়া সস্তা ফুল তোলা চাদর দিয়ে ভাঙাচোরা সোফাটাকে ঢাকার চেষ্টা হয়েছে। আর একধারের দেওয়ালে, প্রায় কুড়ি বছরের পুরনো ফ্যাশানের পোষাকে সজ্জিত এক তরুনীর পেইন্টিং, ভালো করে দেখলে মণিকুন্তলা দেবীর সাথে মিল পাওয়া যায়।

 “এই পরিবেশ বিসদৃশ লাগতো না মা-” রঞ্জনা অন্যমনস্ক স্বরে বলে চলে – “যদি  আমাদের অন্য কোথাও থাকার অভিজ্ঞতা না থাকত , কিন্তু যখনই মনে পড়ে ‘রায় ভিলা’র কথা —” থেমে যায় সে।

 তাদের রায় পরিবারের বহু বহু বছরের স্মৃতিযুক্ত প্রাসাদপম বাড়ির কথা মনে পড়লে, সে নিজেকে সামলাতে পারে না। সেই বাড়ি আজ কোন এক অচেনা লোকের হেপাজাতে চলে গেছে।

“যদি বাবা – – ধার করে ফাটকার ব্যবসায় না যেত – -”

“ রঞ্জনা  – তোর বাবা কখনই টাকাপয়সার ব্যাপারস্যাপার ঠিক বুঝত না। কোনো মতে ব্যবসায়ী হয়ে উঠতে পারেনি। ব্যবসায়ী বুদ্ধি একেবারেই ছিল না ওনার।” মণিকুন্তলা দেবীর শান্ত, স্বভাবজ সম্ভ্রান্ত স্বর।

রঞ্জনার খারাপ লাগে কথা গুলো বলে। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে, কয়েক পা এগিয়ে এসে তাঁকে জড়িয়ে ধরে – “ আমার মা–, আমি কখনো আর ওই কথা গুলো বলব না মা।”

মণিকুন্তলা দেবী আবার কলম তুলে নিয়ে ঝুঁকে পড়েন হিসেবের খাতায়।

জানলার ধারে আবার গিয়ে দাঁড়ায় রঞ্জনা। এখন সে ধীর স্বরে বলে –“ মা, আজ সকালে গৌতম বলছিল, ও আমাদের এই বাড়িতে আসতে চায়।”

মণিকুন্তলা দেবী চমকে উঠে কলম রেখে হিসেবের খাতা থেকে চোখ তোলেন – “ এখানে আসবে ?”

“ এখানে না’তো কোথায় আসবে? – আমরা তো আর ওকে পার্ক হোটেলে ডাকতে পারি না!”  হাল ছাড়া হতাশায় হাসে রঞ্জনা। তার সুন্দর মুখটা যন্ত্রণায় কুঁচকে যায়।

রঞ্জনার মুখে কষ্টের ছায়া মণিকুন্তলাকে অসহায় করে তোলে। আবার তিনি ঘরটায় চোখ বোলান – ‘সত্যিই এই ঘরে কাউকে এনে বসানো যায় না।’

 “ তোমার ভাবনাটা একেবারে ঠিক” রঞ্জনা এবার ঝাঁঝিয়ে ওঠে। “ এটা জঘন্য জায়গা। গরিবের আভিজাত্য? শুনতে খুব ভালো লাগে।  সাধারণ ভাবে কোনরকমে সাজানো ছোট্ট দুটো ঘর, টিমটিমে আলো, টেবিলে প্লাস্টিকের ফুলদানে নকল ফুলের তোড়া, মান্ধাতা আমলের পোর্সিলিনের একটা দুটো কাপ ডিশ । কাজের লোক নেই – নিজেদের ঘর ঝাড়া মোছা করতে হয়, রাস্তার কল থেকে জল আনতে হয় -বইতে এসব পড়তে খুব ভালো লাগে, মা। আচ্ছা ভেবে দেখ ! আমাদের সত্যি অবস্থাটা কি? রায় বাড়ির ছেলে আমার ভাই, এখন সংসারের খরচ যোগাতে শহরের সাধারণ অফিসে চাপরাসীর কাজ করে। অসভ্য বাড়িওলা, নোংরা, ধুলো কাদা মাখা বাচ্ছাগুলো সবসময় সিঁড়িতে জটলা পাকাচ্ছে, অন্য ভাড়াটে গুলো – বেশীর ভাগ সময় মাতাল হয়ে থাকে – আর কি বলবো বলো তো?   

 “ কিন্তু – ” মণিকুন্তলা দেবী বলার চেষ্টা করেন – সত্যিটা কি জানিস – আমার মনে হচ্ছে এই ঘরদুটোর খরচও আর বোধহয় বেশি দিন চালানো যাবে না।”

 “ তার মানে বলতে চাইছো – আমাদের এবার এই দু’ঘরের আস্তানা ছেড়ে, আরো খারাপ জায়গায় এক কামরার কোনো ঝুপড়িতে চলে যেতে হবে – যেখানে কেবল তোমার আর আমার থাকার জায়গা হবে। আর রাতে আমার ভাই, সৌমেন্দ্র’কে থাকতে হবে ঝুপড়ির বাইরে,রাস্তার ধারে? আর আমি কি ভাবে গৌতমকে এই পরিবেশে আসতে বলবো মা? তুমি তো দেখছো আসপাশের লোকজনদের। মেয়েগুলো অসভ্যরমত সিঁড়িতে বসে সর্বক্ষণ নিজেদের মধ্যে নীচ ভাষায় ঝগড়া করে চলেছে আর মাতাল লোকগুলোর দিনরাত বেলেল্লাপনা করছে। এই জায়গায় কোনো ভদ্রলোককে নিয়ে আসা যায় ?”

ঘরে নিশ্তব্ধতা নেমে আসে।

“রঞ্জনা – তুই কি গৌতম কে! মানে –তুই –?”

মণিকুন্তলা যেন একটু ইতস্তত করে থেমে যান। তিনি অসহায় বোধ করেন।

 “ দেখ মা, এত ইতস্তত করার কোনো দরকার নেই। আর আজকাল কেউ করেও না। তুমি নিশ্চয়ই বলতে চাইছো, আমি গৌতমকে বিয়ে করতে চাই কিনা ? তবে শোনো – হ্যাঁ, গৌতম যদি আমাকে বিয়ে করতে চায় – আমি রাজি হয়ে যাব। কিন্তু আমি জানি – সে আমাকে বিয়ের প্রস্তাব কখনো দেবে না।”

রঞ্জনার কথায়- মণিকুন্তলার বুক যেন ব্যাথায় মুচড়ে ওঠে। রঞ্জনা বলে যায়-

 “ মা, চিন্তা করে দেখ – কাবেরী মাসি আর তিন্নীর সঙ্গে আমি সেই কয়েকটা দিন ঘুরে বেড়িয়েছি ব্যাঙ্গালোরের অভিজাত মহলে। গৌতম আমাকে দেখেছে সেই বিশেষ পরিবেশে। সেই সামান্য কটা দিন আমরা ঘুরে বেড়িয়েছি খোলা মনে। সেই পরিবেশে আমাকে দেখে সে হয়ত আকৃষ্ট হয়েছিল।– তোমার মনে আছে হয়তো সিন্ডেরেলা গল্পটা। রূপকথার রাজপুত্ররা অনেক কিছু উপেক্ষা করতে পারে কিন্তু বাস্তবের রাজপুত্ররা অতটা দরাজ নাও হতে পারে কারণ তাদের নিজেদের সমাজের কথা মাখায় রাখতে হয়।

আর গৌতম এখানে – এই বস্তির ঝুপড়িতে এসে আমাকে দেখবে! সিন্ডেরেলার রাজপুত্র আার বর্তমান বাস্তবের রাজপুত্রের ধ্যানধারণার ফারাক আছে মা। গৌতম দরাজ মনের সম্ভ্রান্ত কিন্তু খুঁতে খুঁতে সাবেকিয়ানার  মানুষ। সেই জন্যই হয়ত ওকে আমার ভালো লেগেছে। গৌতমের চালচলন, দৃষ্টিভঙ্গি আমাকে মনে পড়িয়ে দেয় আমাদের ‘রায় ভিলা’র পরিবেশ, পুরনো আভিজাত্য, সম্ভ্রান্ত আত্মীয় স্বজনের আনাগোনা। আমাদের বাড়িতে ঢুকলেই যেন পৌঁছে যেতাম কোন পুরনো রুপকথার কল্পনার জগতে। টের পেতাম কত দিনের পুরনো ইতিহাসের গন্ধ যেন জড়িয়ে আছে ওই বিশাল বাড়ির আনাচে কানাচে। আমাদের এই এখনকার পরিবেশের থেকে যেন কত দুরে – অন্য কোন অচেনা এক জগৎ।

রঞ্জনার  লজ্জা পায় তার ভেতরের আক্ষেপ বেরিয়ে আসাতে।

.

“ দ্যাখ রঞ্জনা- গৌতমরা সম্ভ্রান্ত  পরিবার। আমাদের পাল্টি ঘর।” মণিকুন্তলা দেবী আন্তরিক স্বরে বলেন –“ তুই গৌতমকেই বিয়ে কর।”

“আমিও চাই, মা” – রঞ্জনার কথায় হতাশার আভাস-“ কিন্তু আমাদের এই অবস্থাটা আমি মেনে নিতে পারছিনা একেবারেই।”

মণিকুন্তলা দেবীর মন ভেঙে যায় রঞ্জনার হতাশায়। তিনি সান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করেন –

“আমার মনে হয় আমাদের এই বর্তমান পরিবেশে গৌতমের তোকে দেখা উচিত। তোকে  ভালোবাসে,দেখবি ও কিছু মনে করবে না।”

রঞ্জনার কষ্ট হয় মা’কে দেখে। বাবা মারা যাওয়ার পর,এত বিষয় সম্পত্তি কয়েক দিনে ধূলিসাৎ হয়ে গেছিল। এক কাপড়ে ছোট দুই ছেলেমেয়ের হাত ধরে, সামান্য কিছু নিজের জমানো টাকাপয়সা আর অল্প কয়েকটা গয়না নিয়ে পরের দয়ায় এই বস্তিতে তাঁকে উঠতে হয়েছিল এক সকালে – সে দোষ তো মা’র নয়। তাঁকেও তো মানিয়ে নিতে হচ্ছে এই পরিবেশে। রঞ্জনা এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে মা’কে –

“ তুমি ঠিক বলেছ – নিজেকে সামলাতে না পেরে, আজ অনেক বাজে কথা বলে ফেলেছি। আমি জানি সব ঠিক হয়ে যাবে একদিন।”  মা’কে আদর করে রঞ্জনা।

মণিকুন্তলার রোজকার এই হিসেব নিকেশ আর ভালো লাগলো না।  উঠে এসে ঘরের কালজীর্ণ শতচ্ছিন্ন সোফাটায় এসে বসলেন। তিনি চিন্তাগ্রস্ত মনে বুঝে উঠতে পারছেন না তাঁর এখন কর্তব্য কি!

 “এটাও ঠিক, পরিবেশ মানুষের মন পাল্টে দেয়। কিন্তু যদি পরস্পরের ভালোবাসা নিখাদ হয় – আমার মিষ্টি মেয়েটাকে যে অবস্থাতেই গৌতম দেখুক না কেন – আমাদের এখনকার দৈন্যদশা তার ভালোবাসায় দাগ কাটতে পারবেনা। তিনি নিশ্চিত। কিন্তু তবু তাঁর মন তোলপাড় হয়, আজকালকার ছেলেরা সহজেই সবকিছুর ওপর স্থান দেয় বর্তমানকে। আবার ভাবেন সৌমেন্দ্র কত সহজে তার বড় হয়ে ওঠার জীবনযাত্রা ভুলে এই বর্তমান পরিবেশের সাথে কেমন মিশে গেছে।

কিন্তু আমি কিছুতেই চাই না আমার ছেলেমেয়েরা এই অবস্থায় আবদ্ধ হয়ে থাকুক। কিছুতেই নয়। আমি জানি সৌমেন্দ্র পাড়ার মোড়ের ওই বজ্জাত  পানওলার মেয়েটির সঙ্গে ঘোরাফেরা করে। মানছি মেয়েটি  ভালো  কিন্তু তারা আমাদের সমগোত্রীয় নয়। এই অসমতার বিষযটি হয়ত আজকালকার দিনে চলে’না কিন্তু মানতে পারিনা। আর আমার রঞ্জু –ওর খুশির জন্য আমি সব কিছু করতে রাজী – হ্যাঁ, সব কিছু। কিন্তু টাকাপয়সা কোথায় ? যা অল্প কিছু গয়না নিয়ে আসতে পেরেছিলাম – তা’ও বিক্রী হয়ে গেছে সৌমেন্দ্রকে স্কুলের গন্ডি পার করাতে। আর এখনকার খরচপত্রও চালানো কঠিন হয়ে উঠেছে।”

এই চিরস্থায়ী অভাবের নিয়ত চিন্তা থেকে মন সরাতে সামনে পড়ে থাকা কয়েকদিনের পুরনো খবরের কাগজটায় অন্যমনস্ক মনে বিজ্ঞাপন গুলিতে তাকিয়ে থাকেন। সাধারণ আবার অদ্ভুত সব বিজ্ঞাপন। কেউ খুঁজছে বিনিয়োগকারী আবার কেউ চাইছে লাভজনক ব্যবসায় লগ্নি করে অল্প সময়ে টাকা তিনগুণ করতে। কেউ আবার পুরানো কিছু আসবাব বিক্রি করতে চায়  নতুনের দামে। তাঁর এই দুর্দশার মধ্যেও হাসি পেয়ে যায় দেখে এক বৃদ্ধ অনুর্দ্ধা তিরিশের পাত্রী খোঁজার চেষ্টায় রয়েছেন। আশ্চর্য হন মণিকুন্তলা দেবী।

হঠাৎ একটি বিজ্ঞপ্তি দেখে তিনি সোজা হয়ে বসেন। দু’বার তিন’বার ভালো করে বিজ্ঞপ্তিটা পড়েন।

“শহরের বর্ধিষ্ঞু অভিজাত এলাকায় সব রকম সুবিধাযুক্ত, উপযুক্ত আসবাবপত্র সমেত ছোট বাড়ি নাম মাত্র ভাড়ায় দেওয়া হবে। যোগাযোগ করবেন শুধু মাত্র নিম্ন মধ্যবিত্ত্ব যথার্থ ভদ্র পরিবার যাঁরা বাড়িটি নিজেদের মনে করে যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণে সক্ষম হবেন। দালাল মারফত যোগাযোগ নিষ্প্রোয়োজন। 

খুবই সাধারণ একটি বিজ্ঞাপন। এই রকম বিজ্ঞাপন তিনি অনেক দেখেছেন। আবার ‘নাম মাত্র’ ভাড়া’! বিশ্বাস হয়’না,এখানেই কোনো চালাকি বোধহয় লুকিয়ে আছে।

রঞ্জনার বিষাদে ভরা মুখটা তাঁর মনে ভেসে ওঠে। বিক্ষিপ্ততা গ্রাস করে তাঁকে। এঁদের সাথে কথা বলতে তো আর দোষ নেই! মানসিক অস্থিরতা থেকে মুক্তি পেতে, ছাতাটা নিয়ে তড়িঘড়ি তখুনি বেরিয়ে পড়েন তিনি। বিজ্ঞপ্তির ঠিকানায় পৌঁছতে, শহরের ওইদিকে যাওয়ার বাস ধরেন মণিকুন্তলা দেবী।

অনেক খোঁজাখুঁজি করে পৌঁছলেন ঠিকানাটায়। সরু গলির ভেতর, পুরানো আমলের জরাজীর্ণ বাড়ির একতলায় অফিস। পুরানো খবরের কাগজ থেকে ছিঁড়ে নিয়ে আসা বিজ্ঞাপনের অংশটি ভয়ে ভয়ে এগিয়ে দিলেন অফিসে একা বসে, ঢুলু ঢুলু চোখে, মাথা ভরা সাদা চুলের বৃদ্ধ ভদ্রলোকের টেবিলে। একটু ইতস্তত: করে বাড়িটির ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করেন।

বিজ্ঞাপনের অংশটি হাতে নিয়ে  বৃদ্ধ ভদ্রলোক কিছুক্ষণ কুন্তলা দেবীকে তিক্ষ্ণ চোখে পর্যবেক্ষণ করে বলেন –

“ঠিক,একেবারে ঠিক। বাড়িটা সম্পর্কে আপনাকে তো জানতেই হবে। বিজ্ঞাপনের বাড়িটা খুব কাছেই, ওই বড় রাস্তার ওপারে–।  আপনি কি বাড়িটা শর্ত অনুযায়ী ভাড়া নিতে ইচ্ছুক ?”- ভদ্রলোক ঠিকানাটা যা বললেন সেটি শহরের সর্বোৎকৃষ্ট এলাকা।

“ভাড়াটা আগে না জেনে রাজী হওয়া কি সম্ভব ?”

“ ওহো! বাড়ির ভাড়া কত জানতে চাইছেন? কিন্তু বাড়ির মালিক ভাড়াটা এখনো ঠিক করে উঠতে পারেননি। তবে বলতে পারি ভাড়াটা হবে খুবই সামান্য।”

“ দেখুন ওই ‘সামান্য’ কথাটা খুবই গোলমেলে। বিভিন্ন মানুষের কাছে এই  ‘সামান্য’ কথাটার পরিমাণ নানারকম হতে পারে।” মণিকুন্তলা দেবী বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে জানালেন।

বৃদ্ধের মুখে চাপা হাসি।

 “আপনার ধারণা একেবারে সঠিক। সত্যি, এই “সামান্য’ শব্দটা খুবই বিভ্রান্তিকর। তবে আমার কথা আপনি বিশ্বাস করতে পারেন। আমার ‘সামান্য’ শব্দটা আক্ষরিক  অর্থে ‘খুবই কম’। এই ধরুন পাঁচ’শো টাকার মধ্যে প্রতি মাস, এর বেশি হবে না।”

মণিকুন্তলা দেবীর ইতস্তত:  হয়ে চিন্তিত হন – বাড়িটা ভাড়া নিতে পারবেন কিনা?  কিন্তু সংসারের সব খরচ আরো কম করলেও মাসে পাঁচ’শো টাকা ভাড়া দেওয়া খুবই মুশকিল। তবে তিনি জানতে চান, এত কম ভাড়া কেন? নিশ্চয়ই বাড়িটার কোনো গোলমাল আছে সেই জন্য বাড়ির মালিক এত কম ভাড়ায় বাড়িটা দিচ্ছে! যদি গোলমাল থাকে, বাড়িটা নেব না বলতে আর কতক্ষণ। আর শুধু একবার দেখতে তো দোষ নেই। তিনি ঠিক করলেন ফিরে যাওয়ার আগে বাড়িটা একবার দেখেবেন।

বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়াতেই – তিনি মুগ্ধ হয়ে গেলেন। প্রায় মানুষ প্রমান উঁচু প্রাচির ঘেরা কি সুন্দর বাড়িটা! বলতে গেলে রাজকীয় – রক্ষণাবেক্ষণ অপূর্ব।  সামনের গেটে পাহারারত সিকিউরিটি গার্ড, তাঁকে দেখেই এগিয়ে আসে – বোধহয় এজেন্ট ভদ্রলোক আগে থেকে তাঁর আসার খবর পাঠিয়ে দিয়েছেন।

দুপাশের ছোট বাগানে একটি মালি ফুলগাছে পরিচর্যারত, নুড়ি ছড়ানো অল্প কিছুটা পথ পেরিয়ে  বাড়ির ভেতরে ছোট গাড়ি বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ধুতি ফতুয়া পরিহিত এক ব্যক্তি বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন। বেশ লম্বা, সাদাটে ধূসর ব্যাক ব্রাশ করা চুল, যত্নে রাখা পুরুষ্টু গোঁফ। বেশ লম্বা শান্ত সৌম্য চেহারা।  সম্ভ্রান্ত আচার আচরণ। মণিকুন্তলা দেবীর মনে হলো লোকটি বোধহয় বাড়ির কেয়ার টেকার। এনার কথাই বোধহয় এজেন্ট ভদ্রলোক বলেছিলেন। লোকটিকে বাড়ির কাজের লোক ভাবতে অস্বস্তি হয়। তবু কথামত এজেন্টের দেওয়া চিঠিটা তার হাতে দিলেন।

 “ আসুন আসুন ম্যাডাম, বাড়িতে থাকার মত ব্যবস্থা সব ঠিকঠাক করা আছে। আপনাকে দেখিয়ে দেব সব।” তিনি মণিকুন্তলা দেবীকে নিয়ে একের পর এক ঘর দেখাতে থাকেন।

“ এই ঘরটা বসার, পাশের ঘরটা লাইব্রেরী, ঘরের সঙ্গে বাথরুম-।” এরপর দেখা হলো দো’তলার বারান্দা লাগোয়া শোওয়ার ঘরগুলি।

ঠিক স্বপ্নের মত পুরানো কলোনিয়াল ধাঁচের দো’তলা বাড়ি।  প্রতি ঘরে অতি যত্নে পালিশ করা রুচিপূর্ণ ভিক্টোরিয়ান আমলের এ্যান্টিক  আসবাবপত্র।  মেজেগুলিতে সুন্দর কিছুটা ম্লান হয়ে যাওয়া পুরানো নকশার পার্শিয়ান কার্পেটে ঢাকা। ঘরে ঘরে বাড়ির বাগানের তাজা ফুলে সাজানো এ্যান্টিক ফুলদান। দো’তলার বারান্দা থেকে দেখা যায় বাড়ির পিছনের মাঝারি সবুজ লন। এক কথায় অপূর্ব। পুরানো আমলের মাধূর্য ছড়িয়ে আছে বাড়িটির সর্বত্র। কর্মচারীর নাম জানলেন মণিকুন্তলা – তার নাম বিপ্রদাস।

মণিকুন্তলা দেবীর বাস্পাকুল দৃষ্টি বাড়িটার আনাচকানাচে ঘুরে বেড়ায়। তাঁদের ‘রায় ভিলা’র ছবি ভেসে ওঠে চোখের সামনে। ওই বাড়িটার সাথে মিল খুঁজে পাচ্ছেন তিনি। আবার চিন্তায় ফেলে ভাড়ার অঙ্কটা – না:,সম্ভব হবেনা । বিপ্রদাসের দৃষ্টি এড়িয়ে রুমালে চোখ মুছে নিজেকে সামলে নিলেন মণিকুন্তলা।

তিনি একটু লজ্জা পেলেন। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বিপ্রদাস তাঁর স্বতস্ফুর্ত ভাবচ্ছাস দেখে ফেলেনি তো? মনে হলো, প্রশিক্ষিত কর্মচারীরা  যদি দেখেও ফেলে, তাদের মনের ভাব প্রকাশ করে না। তিনি এই পুরানো লোকদের পছন্দ করেন। ঠিক পারিবারিক বন্ধুর মত। এদের কাছে থাকলে তিনি স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন, নিজেকে নিরাপদ মনে হয়।

 “ বাড়িটা খুব সুন্দর, সত্যি অপূর্ব, বাড়িটা দেখে আমার ভীষণ ভালো লাগলো।” শান্ত আয়ত্তে রাখা স্বরে বলেন মণিকুন্তলা।

“আপনি কি একাই থাকার জন্য বাড়ি খুঁজচ্ছেন ম্যাডাম ?”

“আমি আর আমার দুই ছেলেমেয়ের থাকার জন্য বাড়ি খুঁজচ্ছিলাম। তবে মনে হচ্ছে……” তিনি থেমে গেলেন। বাড়িটা তাঁর ভীষণ ভালো লেগেছে। ছেড়ে চলে যেতে মন চাইছে না। তবে ওই ভাড়ার টাকার অঙ্কটা তাঁর কাছে অনেক। তিনি যোগাড় করবেন কি করে ?

তাঁর অবচেতন বলছে বিপ্রদাস বোধহয় আসল ব্যাপার বুঝতে পেরেছে। সে তাঁর দিকে না তাকিয়ে নির্লিপ্ত উদাসীন ভদ্র স্বরে বলে –

“দেখুন, আমি জানি কর্ত্তামশায়ের ইচ্ছে। তিনি এমন একটি পরিবারকে বাড়িটা ভাড়া দিতে চান-যাঁরা সত্যি সত্যি বাড়িটাকে ভালোবাসবে, নিজেদের মত করে যত্ন, রক্ষণাবেক্ষণ করবে। তাঁর কাছে ভাড়ার টাকার অঙ্কের কোনো মূল্য নেই।”

“ আমি মন থেকে বাড়িটিকে ভালোবেসে ফেলেছি বিপ্রদাস।” মণিকুন্তলা দেবী মৃদু স্বরে ব’লে – সদর দরজার দিকে পা বাড়ালেন।

“ বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখানোর জন্য তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।” দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সৌজন্যের সাথে বলেন মণিকুন্তলা দেবী।

বিপ্রদাস হাতজোড় করে তাঁকে নমস্কার জানায়। তার সম্ভ্রমের দৃষ্টি স্থির হয়ে থাকে- মণিকুন্তলার মাথা উঁচু করে, গর্বিত পদক্ষেপে একবারও ফিরে না তাকিয়ে রাস্তা ধরে হেঁটে চলে যাওয়ায় দিকে। মনিকুন্তলা নিজের মনে ভাবেন-‘তাঁর অসুবিধেটা কোথায় লোকটি বুঝতে পেরেছে, বোধহয় আমার জন্য দু:খও পেয়েছে। তিনি অনুভব করেন এই জাতের মানুষেরা বর্তমান যুগ থেকে ক্রমশ: উধাও হয়ে যাচ্ছে। লোকটি চাইছে আমাদের পরিবার বাড়িটায় থাকুক নচেৎ কোন লোহা লক্কড়ের ব্যবসায়ী হয়ত শেষ অবধি বাড়িটা দখল নেবে। ক্রমশ: অবলুপ্তির পথে বনেদীয়ানা, ওই লোকটিও একই দলে – আমাদের মত এই শ্রেণীর মানুষদের এক জোট হওয়া উচিত। কিন্তু তালপুকুরে আর ঘটি ডোবে না।’ 

মণিকুন্তলা পথ চলতে চলতে ঠিক করেন এজেন্ট লোকটির অফিসে আর যাওয়ার দরকার নেই। লাভই বা কি? যা হোক করে টেনেটুনে হয়ত মাসের ভাড়াটা দেওয়া যাবে কিন্তু অন্যান্য খরচা ? ওই বাড়িতে থাকতে হলে কাজের লোক জরুরী, তা ছাড়া নিজেদের দৈনন্দিন খরচ?

পরের দিন সকালটা তাঁর অনেক দিন মনে থাকবে। যথারীতি তিনি বসেছিলেন হিসেবের খাতা নিয়ে। ওই সময় দরজার কড়া নাড়ার শব্দে, উঠে গিয়ে দেখেন ডাকপিয়ন দাঁড়িয়ে আছে চিঠি নিয়ে। আশ্চর্য হয়ে চিঠিটা পড়ে তিনি হতবাক। চিঠিতে বলা হয়েছে বাড়ির মালিকের নির্দেশে ওই বাড়িটা দু’শো টাকা মাসিক ভাড়ায় ছয় মাসের জন্য মণিকুন্তলা দেবীকে দেওয়া হলো। চিঠিটা পাঠিয়েছেন এজেন্ট ভদ্রলোক, সংক্ষিপ্ত কথায় আরো বলেছেন – “ নির্দেশ অনুযায়ী –কাজের লোকজনরা বাড়ির কাজের জন্য থাকবে মালিকের খরচে। আশা করি বাড়ির মালিকের প্রস্তাবে আপনি রাজী হবেন।”

সত্যিই অবাক করা প্রস্তাব। তিনি আশ্চর্য হয়ে নিজেকে বিশ্বাস করানোর জন্য চিঠির শব্দগুলি একটু উঁচু স্বরে পড়েন। হতবাক অবস্থার শেষ সীমায় শুনতে পান তাঁকে কেউ পর পর কিছু জিজ্ঞাসা করছে। হুঁশ ফিরতে দেখেন রঞ্জনা আর সৌমেন্দ্র, দু’জনেই ঘরে রয়েছে –

 “চুপি চুপি বাড়ি দেখে এসেছে মা!” আনন্দে চেঁচিয়ে ওঠে রঞ্জনা।“ সত্যি কি বাড়িটা খুব সুন্দর?”

মণিকুন্তলা দেবী অল্প কথায় ছেলেমেয়েদের বাড়িটার বর্ণনা দিলেন।

সৌমেন্দ্র একটু সন্দেহর চোখে পুলিশের মত জেরা শুরু করে –

“ এর পিছনে নিশ্চয়ই কিছু গোলমাল আছে। ব্যাপারটা রহস্যজনক। আমি নিশ্চিত এর ভেতর গভীর রহস্য লুকিয়ে আছে।”

 “তুই চুপ কর সৌম্য,” রাগত স্বরে বলে রঞ্জনা। “এটার ভেতর সন্দেহর কি আছে’রে ? ওই রাবিশ ডিটেকটিভ বইগুলো পড়ে পড়ে সব কিছুতে রহস্য খুঁজে বেড়াস।”

“ দ্যাখ দিদি, ভাড়ার টাকার অঙ্কটাই রহস্যজনক,” সৌম্য বিজ্ঞের মত বলে –“আমাদের শহরে, ওই এলাকায় এত কম ভাড়ায় বাড়ি কি করে সম্ভব?” গম্ভীর স্বরে আবার তার মন্তব্য-

“ আমাদের সাবধান হওয়া উচিত। আমার মনে হচ্ছে,এই রকম অদ্ভুত প্রস্তাবের মধ্যে নিশ্চয়ই কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে।”

 “ বাজে কথা বলিস না,” রঞ্জনা রাগত হয়ে বলে। “ ঘটনাটা খুব সাধারণ, স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে কোনো পয়সাওলা লোকের খুব প্রিয় ওই বাড়িটা। মনে হয় বেশ কিছু দিনের জন্য তিনি এখানে থাকবেন না। সেই জন্য কোনো ভদ্র পরিবার খুঁজচ্ছেন যাঁদের হাতে বাড়ির ভার দিয়ে যাবেন। এর মধ্যে রহস্যটা কোথায় ? আর তুই যখন বলছিস  তিনি যথেষ্ট পয়সাওয়ালা মানুষ, তার মানে দাঁড়ায় এই সামান্য ভাড়ার জন্য তাঁর কোনো চিন্তা নেই।”

 “ তুমি বাড়িটার ঠিকানা কি বললে যেন?” সৌমেন্দ্র তার মা’কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি ঠিকানাটা আবার জানালেন।

 “উফ!” সে ভাঙা সোফা থেকে উঠে দাঁড়ায়-  “বলেছিলাম এর মধ্যে নিশ্চয়ই রহস্য আছে। তোমরা কি জানো, শহরের নামকরা ব্যবসায়ী বিশাল পয়সাওয়ালা রণেন্দ্র সরকার হঠাৎ একদিন ওই বাড়িটা থেকে উধাও হয়ে যান?”

“তুই সত্যি জানিস?” মণিকুন্তলা দেবীর সন্দেহের সুর।

 “আমি এই বিষয়ে নিশ্চিত মা। ভদ্রলোকের এই শহরে অনেকগুলো বাড়ি আছে, কিন্ত তুমি যে ঠিকানার বলছ, তিনি ওই বাড়িটায় থাকতেন। খবরের কাগজে বেরিয়েছিল তিনি এক সন্ধ্যায় ক্লাবে যাবেন জানিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আর ফেরেন নি। সেদিনের পর কেউ আর তাঁকে দেখেনি। অনেকে ভেবেছিল ভদ্রলোক কাউকে না জানিয়ে বিদেশে কোথাও উধাও হয়েছেন। চেনাজানা লোকেরাও ওনার উধাও হওয়ার কারণ খুঁজে পায়নি।” সৌম্য কিছুক্ষণ থেমে, বলতে থাকে –

“এই জন্য আমার স্থির বিশ্বাস ওই বাড়িতে ভদ্রলোক নিশ্চয় খুন হয়েছেন।  আর তুমি বলছিলে না বাড়ির দেওয়ালগুলো কাঠের প্যানেলে মোড়া?

 “ হ্যাঁ ” মণিকুন্তলা চিন্তান্বিত হন – “তবে –”.

সৌম্য তাঁকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে অতি উৎসাহে বলে যায়-

 “ প্যানেলিং ছিল তো! তা’হলে চিন্তা কর – নিশ্চয়ই প্যানেলের আড়ালে কোথাও লুকোনো খুপরি ঘরে মৃতদেহটা সেই খুনের রাত থেকে পড়ে আছে। দেখ হয়ত পচনরোধক ওষুধ দেওয়া কাপড় জড়িয়ে রাখা আছে যাতে গন্ধ না বেরোয়।”

 “ দ্যাখ সৌম্য-বাজে বকার একটা সীমা আছে,” মণিকুন্তলা বিরক্ত হন।

“ বোকার মত কথা বলিস না, ওই সব বস্তাপচা ডিটেকটিভ গল্পগুলো পড়ে তোর মাথাটা নিরেট হয়ে গেছে।” রঞ্জনাও রেগে ওঠে।

সৌম্য তার রোগাসোগা লম্বা শরীরে আর কুড়ি বছর বয়সের যতটা সম্ভব গাম্ভীর্য নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে তার শেষ কথা জানিয়ে দেয় –

“ বাড়িটা নিয়ে নাও মা। তবে দেখো একদিন আমি ওই বাড়ির আসল রহস্যটা ঠিক খুঁজে বার করবো।” অফিসে দেরী হয়ে যাওয়ার ভয়ে সে প্রায় দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। 

মা আর মেয়ে পরস্পরের দিকে চিন্তান্বিত হয়ে তাকিয়ে থাকে।

“ খরচ চালানো কি সম্ভব হবে মা ?” রঞ্জনা কাঁপা স্বরে বলে।“ যদি একটা চাকরী জোগাড় করতে পারতাম!”

“দ্যাখ রঞ্জু – সেখানে অনেকগুলো কাজের লোকজন আছে,” মণিকুন্তলা কিছুটা যেন ভেঙে পড়ে বলেন, “ তাদের হয়ত মাইনে দিতে হবে না কিন্তু তাদের খাওয়া দাওয়া তো আছে, তারা আমাদের সঙ্গে থাকবে, তখনতো ভার নিতে হবে – ওইটাই বেশ মুশকিলে ফেলবে। আমাদের নিজেদেরটা কমবেশী করে চালিয়ে নেওয়া যায় – কিন্তু সঙ্গে থাকা কাজের লোকজনদের –”

তিনি করুণ দৃষ্টিতে তাকান মেয়ের দিকে, রঞ্জনা নি:শব্দে সায় জানায়।

“ দেখি একটু চিন্তা করে,” মণিকুন্তলা বলেন।

মণিকুন্তলা দেবী, ‘রায় ভিলা’ থেকে চলে আসার পর, এখন বাস্তব অবস্থাটা ভালো বোঝেন। এই নতুন ভাড়া বাড়ি নিয়ে আলোচনার সময় দেখেছেন রঞ্জনার চোখ দুটো আশার আনন্দে ঝলমল করে উঠতে। তিনিও ভেবেছেন রঞ্জনাকে যথোপযুক্ত পরিবেশে দেখুক গৌতম। সৌম্যরও দরকার তার বড় হয়ে ওঠার জন্য সঠিক পরিবেশ। সুযোগ যখন পাওয়া গেছে – এই সুন্দর সুযোগটা তিনি হারাতে চান না। আবার রায় বাড়ির পারিবারিক বনেদীয়ানা ধরে রাখার উপায়ও পাওয়া গেছে। সেই সঙ্গে সংসার চালানোর খরচ আরো হিসেব করে করতে হবে। তিনি মন ঠিক করে ফেলেন। .

তিনি তখুনি ভাড়ার নতুন শর্তাদি স্বীকার আর বাড়িটায় ওঠার দিনক্ষণ জানিয়ে এজেন্টকে চিঠি লিখে দিলেন।

মণিকুন্তলা দেবী দিনক্ষণ অনুযায়ি সরকার বাড়িতে উঠে এলেন।

একদিন সকালে –  “ বিপ্রদাস- রোজ এতো গোলাপ কোথা থেকে আসে? বাড়ির বাগানে তো দেখিনি! এত দামী ফুল আমি কিন্তু কিনতে পারবো না।”

“ ফুল তো আসে কর্ত্তামশাইয়ের বারাসাতের বাগান বাড়ি থেকে। এই বাড়ির নিয়ম অনুযায়ী বাগানের মালী রোজ সকালে ফুল দিয়ে যায়।” পরিপাটি পরিস্কার ধুতি ফতুয়ায় সজ্জিত বিপ্রদাস বিনীত স্বরে কৈফিয়েত দিয়ে নি:শব্দ পা’য়ে ঘরের বাইরে চলে যায়।

স্বস্তির নি:শ্বাষ ফেলেন মণিকুন্তলা।

গত দু’মাস, বিপ্রদাসের ব্যাবস্থাপনায় তাদের জীবন মসৃণ গতি পেয়েছে। কোনো চিন্তা করতে দেয় না লোকটি। ধীরে ধীরে তিনি কি পুরোপুরি বিপ্রদাসের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন! মনে হয় এই লোকটিকে  ছাড়া তিনি আর বোধহয় চলতে পারবেন না। তিনি ভাবেন ‘কোনো ভালো, বেশী দিন টেকে না। হঠাৎ জেগে উঠে দেখবেন, সবই স্বপ্ন।’ এ’যেন স্বপ্নের জীবন। ‘রায় ভিলা’র দিনগুলো মনে পড়িয়ে দেয়। বাড়িটায় থাকতে এত ভালো লাগছে। এই দুটো মাস যেন কোথা দিয়ে কেটে গেল, বোঝা গেল না।’

জীবনটা সত্যি হয়ে উঠেছে আশ্চর্যজনক মনোরম। বিপ্রদাসের হাবভাবে প্রকাশ পায় এই বাড়িতে তার একছত্রতা। একদিন সে সসম্ভ্রমে বিনয়ের সাথে জানিয়েছিল “ বাড়ির সবকিছু আমার ওপর ছেড়ে দিন ম্যাডাম। দেখবেন আপনি নিশ্চিন্তে থাকবেন।”

প্রতি সপ্তাহে, বিপ্রদাস হিসেবের খাতা নিয়ে আসে। কুন্তলা দেবী অভ্যাস মত হিসেব পরীক্ষা করেন। তিনি আশ্চর্য হন ভেবে – তাঁর বস্তিতে থাকার সময়ের সাপ্তাহিক খরচের থেকে এখনকার খরচ অনেক কম হচ্ছে! এই বাড়িতে বিপ্রদাস ছাড়া, রাঁধুনী, মালী আর পরিচারিকা আছে। তার খুবই ভদ্র ও কর্মঠ, কিন্তু বিপ্রদাস পুরো বাড়ির দেখাশোনা করে। প্রায় রোজ খাওয়া টেবিলে নানা রকম মাছ মাংসের পদ লক্ষ্য করে মণিকুন্তলা দেবীর উদ্বেগ  প্রশমিত করে বিপ্রদাস- “এই বাড়ির বরাবরের নিয়মানুসারে মাছ মাংস সব কর্ত্তামশাইয়ের বারাসাতের বাগানবাড়ির পুকুর,পোলট্রি থেকে আসে।”   

মণিকুন্তলা মনে মনে চিন্তা করেন। তিনি লক্ষ্য করেছেন বিপ্রদাস তাঁর ও তাঁর পরিবারের প্রতি যেন একটু বেশী অনুরক্ত হয়ে পড়েছে। সে যেন তাঁকে খুশী দেখার জন্য সবকিছুই অতিরিক্ত করছে। তিনি অস্বস্তি বোধ করেন।  তাঁর সন্দেহ হয় বাড়ির মালিকের তার এই এক্তিয়ার বহির্ভুত কাজে বা কথায় সম্মতি আছে কিনা।

সৌম্যর সেদিনকার কথাগুলোয় তাঁর মনে অতিরিক্ত চিন্তার মেঘ ঘনায়। কৌতুহল চেপে রাখতে না পেরে এরমধ্যে একদিন বাড়ির এজেন্টের অফিস গিয়ে অন্য কথার ভেতর তিনি বাড়ির মালিকের প্রসঙ্গ তুলতেই, সাদা চুলের বৃদ্ধ ভদ্রলোক বিষয়টা স্পষ্ট করে দিলেন – “ খুব স্বাভাবিক আপনার প্রশ্নটা। রণেন্দ্র সরকার আজ প্রায় দেড় বছর হলো মুশৌরির  ল্যান্ডর  কলোনীর কাছের একটি গ্রামে তাঁর বাংলোতে থাকেন। উনি একটু ছন্নছাড়া প্রকৃতির মানুষ।” একটু হাসলেন বৃদ্ধ ভদ্রলোক।

 “সরকার সাহেব হঠাৎ একদিন শহর ছেড়ে চলে যান।  আপনার মনে আছে বোধহয় এই নিয়ে সেই সময় খবরের কাগজে কিছু লেখালেখি হয়েছিল? তিনি  কাউকে কিছু জানিয়ে যান নি। পুলিশও অনেক তদন্ত করেছিল। ভাগ্যক্রমে সবকিছু জানিয়ে তিনি পুলিশকে চিঠি দিয়েছিলেন, হইচই সব থেমে যায় সেইসময়। যদিও তাঁর এক ভাগ্নে আছেন কিন্তু তিনি শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে তাঁর সব বৈষয়িক ব্যাপার সামলাবার জন্য শহরের এক নামী সলিসিটরকে পাওয়ার অফ এ্যাটর্ণী নিযুক্ত করে দিয়ে যান। হ্যাঁ,  ঠিক ধরেছেন – তিনি বেশ খাপছাড়া, খামখেয়ালী মানুষ। যদিও তাঁর বয়স হচ্ছে কিন্তু অদ্ভুত খেয়ালে তিনি জনবিরল বন্য জায়গায় ঘুরে বেড়াতে বা থাকতে পছন্দ করেন। আমার মনে হয় তিনি এই শহুরে জীবনে কবে ফিরবেন বা আদৌ ফিরবেন কিনা, কেউ জানেনা। আর বিপ্রদাস তাঁর খাস খানলামা। সে সরকার সাহেবের পছন্দ অপছন্দয় পুরোপুরি ওয়াকিবহাল।”

শুনতে শুনতে মণিকুন্তলা দেবীর চোখের সামনে ভেসে ওঠে অনেক দিন আগে কোনো বিদেশী ম্যাগাজিনে দেখা একটি ছবি। খুব সম্ভবত অষ্টাদশ শতাব্দীর কোনো পোড়খাওয়া বৃদ্ধ নাবিকের, দাড়ি গোঁফের জঙ্গলে ঢাকা বলী রেখাঙ্কিতে মুখে ক্লে পাইপ।  – “ মি:সরকারের বোধহয় খুব একটা বয়স হয়নি?” জিজ্ঞাসা করেন তিনি।   

 “ মাঝ বয়সি বলতে পারেন, সরকারি পরিচয়পত্র অনুযায়ি, ওনার তিপ্পান্ন বছর বয়স হবে।” বলেন সাদা চুলের ভদ্রলোক। .

সৌম্য সব শুনে নিজের ধারণা আরো সুস্পষ্ট করে-

 “ মা দ্যাখো – ব্যাপারটা আমার কাছে আরো জটিল হয়ে উঠছে- ওই ভাগ্নেটি কে ? ও ঠিক জানে, রণেন্দ্র সরকারের কিছু হয়ে গেলে পুরো সম্পত্তি তার হয়ে যাবে। মুশৌরির থেকে পুলিশকে পাঠানো চিঠিটা নিশ্চয়ই জাল। আমি বইতে পড়েছি, আইন অনুযায়ী কোনো নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রণেন্দ্র সরকারের হদিশ না পাওয়া গেলে, তাঁকে মৃত ধরে নেওয়া হবে আর ভাগ্নে সম্পত্তি পেয়ে যাবে।”.

মণিকুন্তলা দেবী আজকাল লক্ষ্য করেছেন সৌম্যর পরিবর্তন। সে যেন ধীরে ধীরে তার কট্টর ধারনা থেকে নিজেকে সরিয়ে এনে বাড়িটার প্রতি যেন সদয় হয়ে উঠছে। কিন্তু ছুটির দিনগুলোয় সে মাঝে মাঝে, বাড়ির দেওয়ালের কাঠের প্যানেলিঙ ঠুকে ঠুকে দেখে, গজ ফিতে নিয়ে কি সব মাপজোক করে, বোধহয় ওগুলোর আড়ালে চোরা কুঠরি আছে কিনা খোঁজে। তবে মনে হচ্ছে সে বোধহয় রণেন্দ্র সরকারের নিরুদ্দেশ রহস্য খোঁজাতে ক্রমশ নিরুৎসাহি হয়ে পড়েছে। তিনি আরো লক্ষ্য করেন সৌম সেই বস্তির পানওলার মেয়েটির সন্মন্ধে আজকাল বিশেষ কোনো উচ্চবাচ্চ করেনা। পরিবেশ মানুষ কে পাল্টে দেয়।

আর রঞ্জনা ? এই বাড়িটায় এসে সে এখন আনন্দ খুশীতে উচ্ছল। গৌতম এখন ঘন ঘন এই বাড়িতে আসে। সময় পেলেই মণিকুন্তলা দেবীর সাথে ছেলেটি গল্প করে। তিনিও তাকে পছন্দ করেন। একদিন গৌতম নানা কথার মধ্যে রঞ্জনাকে বলা কিছু কথা তাঁর কানে আসায় তিনি আশ্চর্য হন।

 “ দ্যাখ রঞ্জনা – এই বাড়িটা দেখে মনে হয়, তোমার মা’র সাথে বাড়িটা আর এর পরিবেশ কেমন যেন সুন্দর ভাবে মিশে গেছে।”

“ মা’র সঙ্গে?” রঞ্জনার স্বরে আশ্চর্য ভাব।

“ হ্যাঁ – তাই বলতে পারো। মনে হয় এই বাড়িটা যেন তৈরি হয়েছে ওনার জন্যই। তোমার মা আর বাড়িটা যেন একাত্ম হয়ে আছে। ভালো করে দেখলে মনে হয় কিছু অস্বাভাবিকতা, বলতে পারো কিছুটা অপার্থিব, রহস্যময় পরিবেশ জড়িয়ে আছে বাড়িটায়।”

 “ সৌম্যর মত কথা বোলো না,” – রঞ্জনা বকুনি দেয় গৌতমকে। “ওর মাথায় সবসময় ঘুরছে, রণেন সরকারের ভাগ্নে ওনাকে খুন করে মৃতদেহ এই বাড়ির কোথাও লুকিয়ে রেখেছে।”

গৌতম হেসে ফেলে।

“ সৌম্যর গোয়েন্দাগিরি নিয়ে প্রবল উৎসাহ দেখে বেশ মজা লাগে। কিন্তু আমি সেই ভাবে কিছু বলতে চাইছি না রঞ্জনা। আমার শুধু মনে হয় এই বাড়ির বাতাবরন যেন কেমন অন্য রকম, এর পারিপার্শ্বিক পরিবেশটা ঠিক পরিস্কার বোঝা যায় না।”

বাড়িটায় কুমণিন্তলা দেবীর পরিবারের প্রায় তিন মাস কেটে যাওয়ার পর, রঞ্জনা একদিন উৎফুল্ল হয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরে –

“ মা, আমরা বিয়ে করব ঠিক করেছি। গতকাল সন্ধেবেলা ঠিক হলো। আমার মনে হচ্ছে যেন কোনো সত্যিকারের রূপকথার জগতে পৌঁছে গেছি।”

মণিকুন্তলা দেবী মেয়েকে জড়িয়ে ধরেন আনন্দে।

 “ জানো মা, গৌতম আমার থেকেও তোমাকে বেশী ভালোবাসে,” রঞ্জনার চোখে দুষ্টুমির হাসি খেলে যায়। মণিকুন্তলা দেবী একটু লজ্জিত হয়ে মজা পেলেন।

“ হ্যাঁ মা- গৌতম বলেছে,” রঞ্জনা আরো উৎসাহের সাথে বলে – “ আমার থেকে নাকি বেশী মানিয়েছে তোমায় এই বাড়িটার পরিবেশে।”

“বাজে কথাগুলো আর বলিস না রঞ্জনা।” 

 “ বাজে কথা নয় মা। গৌতম বলেছে ‘এই মায়াময় বনেদীয়ানা জড়ানো বাড়িটার স্বপ্নিল পরিবেশে  ঘুরে বেড়াচ্ছেন তোমার মা, যেন গর্বিতা রাজকুমারী আর বিপ্রদাস হল – বলতে পারো!! হ্যাঁ – ঠিক যেন– হিতৈষী জাদুকর’।”

মণিকুন্তলা দেবী হেসে ফেলেন। তবে তিনি মেনে নিলেন রঞ্জনার কথার শেষ অংশ –‘বিপ্রদাস হল হিতৈষী যাদুকর’।

সৌম বাড়ি ফিরে দিদির বিয়ের খবরটা শান্ত ভাবে শুনে  –

 “ আমি ঘটনাটা আন্দাজ করেছিলাম মা।” বেশ বিজ্ঞের মত তার মন্তব্য।

সেই রাতে রঞ্জনা বেরিয়েছিল গৌতমের সঙ্গে – সৌম্য ও মণিকুন্তলা রাতের খাওয়া সারছে। রামদাস ধীর স্থীর পা’য়ে এসে এক প্লেট নানা রকম মিষ্টি টেবিলে রেখে নি:শব্দে চলে যায়।

“ আজব বুড়ো একটা”-বন্ধ হওয়া দরজা দিকে ইঙ্গিত করে সৌম্য, “ বুড়োটার হাবভাব ঠিক সুবিধের নয়, কিছু যেন —”

মণিকুন্তলা মৃদু হেসে সৌমকে থামিয়ে বলেন – “ রহস্যময় বলতে চাইছিস ?”

“তুমি কি করে বুঝলে কি বলতে চাইছি?” সৌম্যর গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞাসা।

“ ওটা তোর কথা সৌম্য, আমার নয়। তুই সব কিছুতে রহস্য খুঁজিস। তোর মাথায় সব সময় ঘুরছে বিপ্রদাস খুন করে রণেন্দ্র সরকারের দেহ বাড়ির মেজের নিচে কোথাও লুকিয়ে রেখেছে?”

“ মেজের নিচে নয়, দেওয়ালের কাঠের প্যানেলের পিছনে কোথাও। তুমি সব সময় ভুল কথাটা মনে কর মা। কিন্তু আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি ভদ্রলোক যেদিন উধাও হলেন, বিপ্রদাস সেদিন ছিল তাঁর বাগান বাড়িতে, এখানে নয়।”

মণিকুন্তলা দেবী একটু হেসে, খাওয়ার ঘর থেকে বসার ঘরের দিকে চলে যান। তাঁর মনে হয় সৌম্য যেন বয়সের অনুপাতে বেশ বড় হয়ে গেছে।

হঠাৎই তাঁর চিন্তায় এই প্রথমবার এলো, রণেন্দ্র সরকার আচমকা জানাশোনা কাউকে না জানিয়ে শহর ছেড়ে চলে গেলেন কেন? ভদ্রলোক খামখেয়ালী হতে পারেন কিন্তু হঠাৎ এত বড় সিদ্ধান্তের পিছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে ! তাঁর ঘটনাটার কারণ নিয়ে চিন্তার সময় বিপ্রদাস কফির ট্রে নিয়ে বসার ঘরে আসে। কুন্তলা ভাবেন এই লোকটা তাঁর সামান্যতম অভ্যাস গুলো মাথায় রেখেছে। ঠিক সময় কফি নিয়ে হাজির। তাঁর মনটা নরম হয়ে যায়। তবুও তিনি আবেগতাড়িত হয়ে তাঁর ধন্দ দুর করতে চান।

 “ বিপ্রদাস তুমি বোধহয় সরকার সাহেবের সঙ্গে অনেক দিন আছো? তাই না ?”

“ হ্যাঁ ম্যাডাম, বলতে পারেন আমার একুশ বছর বয়স থেকে। তখন সাহেবের বাবা মালিক ছিলেন। আমি তখন এই বাড়ির খুব সাধারণ কাজগুলো করতাম।”

“তুমি তা’হলে এখনকার মালিককে ভালো করেই চেনো, কেমন ধরনের মানুষ তিনি?”

বিপ্রদাস ট্রে তে রাখা চিনির পাত্রটা একটু কাছে সরিয়ে দিল তাঁর সুবিধের জন্য, সেই সঙ্গে নির্লিপ্ত স্বরে উত্তর দেয় –

“ সরকার সাহেব ভীষণ স্বার্থপর মানুষ ছিলেন ম্যাডাম,অন্যের ভালোমন্দের দিকে তাঁর কোনো নজরই ছিল না।”

সে স্বভাব মত খালি ট্রে নিয়ে নি:শব্দে বসার ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। মণিকুন্তলা দেবী কফির কাপ হাতে অন্যমনস্ক হয়ে বসে থাকেন।

বিপ্রদাসের তার মালিকের ব্যাপারে মন্তব্য ছাড়াও তাঁর হঠাৎ অন্য কোনো কথায় যেন খটকা লাগে। পর মূহূর্তে তাঁর মনে পড়ে যায় শব্দগুলো।

বিপ্রদাস তার মালিক সন্মন্ধে মন্তব্যে তাঁর উদ্দেশ্যে একটি শব্দ উল্লেখ করেছে– ‘ছিলেন’’, যে শব্দে অতীত বোঝায়। তার মানে বিপ্রদাস পুরোপুরি ওয়াকিবহাল বা সে জানে তার মালিক আর নেই? তিনি সোজা হয়ে বসেন। তাঁর চিন্তাধারা কি সৌম্যর পথে চলেছে!! কি যেন এক অস্বস্তিতে তিনি জর্জরিত হতে থাকেন। সেই মুহূর্ত থেকে একটা সন্দেহ তাঁর মনে দানা বাঁধতে থাকে।

রঞ্জনা জীবনের আনন্দ খুঁজে পেয়েছে, সে এখন সুরক্ষিত। তাঁর এবার সময় এসেছে নিজের চিন্তায় মনোনিবেশ করার। কিন্তু তিনি আশ্চর্য হন, – তাঁর চিন্তা এখন নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আবর্তিত হচ্ছে রণেন্দ্র সরকারের নিরুদ্দেশ রহস্যে। সত্যি ঘটনাটা কি হতে পারে? বিপ্রদাস সত্যি কি কিছু জানে? এই পরিবারের এতদিনকার লোক হয়েও, সে ওই অদ্ভুত মন্তব্য কেন করল- “ভীষণ স্বার্থপর মানুষ, অন্যের ভালোমন্দের দিকে কোনো নজর ছিল না” – কথাগুলো বলার পিছনে কি ছিল ? মনে হলো বিপ্রদাস যেন সমাজের বিচারকের ভূমিকায় উদাসীন নিরপেক্ষ রায় ঘোষণা করছে !! 

বিপ্রদাস কি রণেন্দ্র সরকারের নিরুদ্দেশ ঘটনার সাথে জড়িত ? সে ওই ঘটানায় সক্রিয় অংশ নিয়েছিল ? সৌম্যর- রণেন্দ্র সরকারের পুলিশের কাছে পাঠানো চিঠি নিয়ে ধারনাটা আগে হাস্যকর মনে হলেও সন্দেহ জাগিয়েছিল। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না, বিপ্রদাস ঘটনাটার সাথে জড়িত।

মণিকুন্তলা তাও ছোট্ট মেয়ের মত বারে বারে নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করেন – বিপ্রদাস এ কাজ করতে পারে না, সে সত্যি ভালো মানুষ। বিপ্রদাসের মতো মানুষ খারাপ হতে পারে না। কিন্তু সে কি কিছু জানে?

ওই দিনের পর, তিনি আর কখনো বিপ্রদাসের সঙ্গে তার মালিক কে নিয়ে কথা বলেন নি। ক্রমশ তিনি ভুলে গেছিলেন বিষয়টা। রঞ্জনা আর সৌম্য, যে যার নিজের বিষয় নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেছে। তাদের সঙ্গে আর কোনো আলোচনা হয়নি।

কয়েক মাস পরে তাঁর মনের কোনে উঁকিঝুঁকি দেওয়া অস্পষ্ট সন্দেহটা হঠাৎ দানা বেঁধে বাস্তব হয়ে ওঠে। সৌম্য দিন চারে’কের ছুটি পেয়ে তার এক বন্ধুর সাথে মোটর বাইক নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছিল। তার বেড়াতে যাওয়ার একদিন বাদে,মণিকুন্তলা দেবী তখন তাঁর লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত, তিনি অবাক হন সৌম্যকে হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকতে দেখে।

“সৌম্য, কি হলো !” তিনি বিস্মিত হয়ে বলেন।

 “আমায় এত তাড়াতাড়ি ফিরতে দেখে আমি জানি মা তুমি আশ্চর্য হবে কিন্তু অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। আমার বন্ধু সুনন্দর নির্দিষ্ট  কোন জায়গায় যাওয়ার ঠিক ছিল না। আমরা ঘুরতে ঘুরতে বারাসাতের কাজীপাড়ার কাছে হাট বসেছে দেখে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম। পরে মনে হল এর কাছেই তো সরকার সাহেবের সেই বাগান বাড়ি!ভাবলাম বাগান বাড়িটা একবার দেখে যাই —”

“ তুই বারাসাত গেছিলি ? কিন্তু কেন?”

“তুমি তো ভালো করেই জানো, আমি প্রথম থেকেই সন্দেহ করেছিলাম এই বাড়ির ব্যাপারটা রহস্যময়, কিছু গোলমাল আছে। যাইহোক, কি দেখলাম জানো, বাগান বাড়ি একটা আছে বটে, তবে জঙ্গল ভরা, ভাঙ্গাচোরা একটা বাড়ি-–- লোকজন কেউ নেই। অবশ্য আমি কোনো আশা করিনি কারণ  জানতাম আমার সন্দেহটা ঠিক।”

সৌম্যর হাবভাব এখন যেন অনেকটা শিকারী কুকুরের মত। সহজাত প্রবৃত্তির বশে মনের খুশীতে ব্যস্ত হয়ে অজানা শিকার খুঁজে বেড়াচ্ছে।

 “ হাটের একটু দুরের গ্রামটা দেখার জন্য আমার খানিকটা এগোতেই কাউকে দেখে চমকে উঠি –  লোকটাকে ওখানে দেখতে পেলাম।”

 “ কোন লোক’কে দেখলি তুই ?”

 “বিপ্রদাসকে—সেই গ্রামের একটা ছোট বাড়ির ভেতরে তাকে যেতে দেখলাম। মনে হল ব্যাপারটা খুব রহস্যময়। বাইক থামিয়ে,কিছুটা পথ পিছিয়ে সেই বাড়িটার দরজায় আওয়াজ করতে, সেই লোকটা নিজেই বেরিয়ে আসে।”

 “ কিছুই তো বুঝতে পারছি না। তুই বেড়াতে যাওয়ার দিন থেকে বিপ্রদাস বাড়ির বাইরে একবারও বেরোয়নি সৌম্য -???

 “তুমি কথার মাঝে বাধা না দিয়ে, একটু চুপ করে শোনো, এবার আসল কথায় আসছি, মা। এটা ঠিক, সে আমাদের বিপ্রদাস নয় কিন্তু লোকটা আবার বিপ্রদাসই বটে। আমি কি বলতে চাইছি – তুমি বুঝতে পারছো কি না জানি না।”

মণিকুন্তলা দেবী সত্যি বুঝতে পারেন না সৌম্যর কথা, সৌম্য তখন বিশদ করে–

“লোকটা বিপ্রদাস,কিন্তু আমাদের বিপ্রদাস নয়। কিন্তু সেই হলো সাচ্চা বিপ্রদাস।”

“ সৌম্য !!” মণিকুন্তলা অসহিষ্ণু হয়ে ওঠেন।

“তুমি পুরোটা শোনো আগে। প্রথমে তাকে জিজ্ঞাসা করি ‘ তোমার নাম বিপ্রদাস, তাই না ?’ বুড়ো বলে- ঠিক –আমারই নাম বিপ্রদাস। আমার সঙ্গে কি দরকার ?’ তখনই আমি বুঝেছিলাম লোকটা আমাদের বিপ্রদাস নয়, যদিও তার চেহারা,হাবভাব ইত্যাদি প্রায় একই রকম। আমি তখন জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে সব জানতে পারলাম। লোকটির কোনো ধারণা নেই কি রহস্যময় ঘটনা ঘটে চলেছে তাকে আড়ালে রেখে। সে – রণেন্দ্র সরকারের আসল খানসামা বিপ্রদাস– লোকটা স্বীকার করে নেয়।  সরকার সাহেবের নিরুদ্দেশ হওয়ার ঠিক ওই সময়ে সে অবসর নিয়েছিল। তাকে থাকার জন্য ওই গ্রামের ছোটা বাড়িটা আর মাসিক পেনসনের ব্যাবস্থাও করা হয়।

তা’হলে তুমি এখন বুঝতে পারছ পুরো রহস্যটা। আমার ধারণাটা কেমন মিলে যাচ্ছে দেখ। এখানকার লোকটা ভন্ড, সে নিজের কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে সাধনের জন্য বিপ্রদাস সেজে রয়েছে। আমার যুক্তি বেশ পরিস্কার। সরকার সাহেব উধাও হওয়ার দিন সন্ধ্যেবেলা এই লোকটা বারাসাতের আসল বিপ্রদাস সেজে এখানে এসে সরকার সাহেবের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে খুন করে এই দেওয়ালগুলোর কোনো প্যানেলের আড়ালে লুকিয়ে ফেলেছে। এইসব পুরনোর বাড়িতে নিশ্চয়ই চোরা কুঠরি  —”   

“ উফ ! তোর ওইসব ধারণার কথা এবার রাখ,” মণিকুন্তলা দেবী রেগে গিয়ে থামিয়ে দেন সৌম্যকে।

“তোর এই রকম সব বিধঘুটে ধারণা আর সহ্য করতে পারছি না। আমি জানতে চাই, বিপ্রদাস, মানে এখানকার বিপ্রদাস কেন এই ধরণের জঘন্য অপরাধ করবে – কেন? যদিও সন্দেহ থাকে – মনে রাখিস আমি একবিন্দু বিশ্বাস করছি না, তবু জানতে চাই কারণটা কি হতে পারে?”

 “তুমি ঠিক ধরেছ,” সৌম্য বলে – “ উদ্দেশ্যটা কি? এই নিয়ে আমি খোঁজখবর করেছি। এই শহরে সরকার সাহেবের অনেকগুলো বাড়ি, ফ্ল্যাট আছে। জানতে পেরেছি আমাদের মতন পরিবারদের অতি অল্প টাকায় আর কাজের লোকেরা বাড়িতেই থাকবে এই শর্তে, প্রায় প্রতিটি বাড়ি গত দেড় বছরে ভাড়া দেওয়া হয়েছে।

মজা হলো, আমাদের বিপ্রদাস, মানে যে লোকটা নিজেকে বিপ্রদাস হিসেবে পরিচয় দিয়েছে, প্রতিটি বাড়িতে কিছু সময়ের জন্য খানসামা সেজে কাজ করে। তার মানে হচ্ছে- কোনো দামী কিছু – ধরো গয়না বা কোনো গুরুত্তপূর্ণ দলিল –বাড়িগুলোর কোনো একটায় লুকিয়ে রাখা আছে যার খোঁজ চোরের দল জানে না। আমার মনে হয় কোনো সংগঠিত চোরের দল আছে। আবার হতে পারে এই ভন্ড বিপ্রদাস একাই কাজটা করছে। আবার মনে ——”

“ সৌম্য ! তুই চুপ করবি?” মণিকুন্তলা দেবী ধমকে থামিয়ে দেন সৌম্যকে- “ তোর আজেবাজে কথায় আমার মাথা ধরে গেছে। যাই হোক এই সব ভিত্তিহীণ কথার কোনো মানে নেই – চোরের দল আর লুকোনো দলিল – যতসব আজগুবী কথা।”

 “ আর একটা ব্যাখ্যা হতে পারে।” অদমিত সৌম্য বলে চলে – “আমাদের বাড়ির এই নকল বিপ্রদাস হয়ত অন্য এমন কেউ একজন  যাকে সরকার সাহেব হয়ত কোনো ভাবে ক্ষতি করেছিলেন। সত্যিকারের বিপ্রদাস একটা ঘটনার কথা বলেছে- ঘটনাটা হয়েছিল এই বাড়িতে  আগের মালী ছিল বৈকুণ্ঠ – যার চেহারার সাথে আমাদের এই ছদ্মবেশী বিপ্রদাসের কিছুটা মিল আছে। হতে পারে সেই পুরনো মালীর হয়ত রাগ আছে সরকার —–”

হঠাৎ কিছু মনে পড়ায় মণিকুন্তলা দেবী চমকে ওঠেন ।

অন্যের ভালোমন্দের দিকে কোনো নজর ছিল না।’ নির্লিপ্ত উদাসীন স্বরে বলা নির্দিষ্ট কথাগুলো তাঁর মনে এসে যায়। খুব সাধারণ কথাগুলো, কিন্তু কথাগুলোর মধ্যে অন্তর্নিহিত কোনো অর্থ কি ছিল?

চিন্তা ভারাক্রান্ত মনে তিনি ভালো করে সৌম্যর কথা শোনেন নি।  শেষ দিকে সে তাড়াহুড়োয় কি সব বলে  – ব্যস্ততার সাথে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

কিছুক্ষণ পরে তাঁর হুঁশ ফেরে। সৌম্য তাড়াহুড়োয় গেল কোথায়? তার বেরিয়ে যাওয়ার আগে বলা কথাগুলো তিনি ভালো করে শোনেন নি। কোথায় গেল সে ? খুব সম্ভবত: পুলিশে গেছে। তা’হলে —

তিনি তাড়াতাড়ি সোফা থেকে উঠে ঘন্টা বাজিয়ে বিপ্রদাস কে ডাকেন।

 বিপ্রদাস সঙ্গে সঙ্গে ঘরে আসে -“ আপনি ডেকেছেন ম্যাডাম ?”

“ দরজাটা বন্ধ করে ভেতরে এস।”

বিপ্রদাস কথামত ঘরের ভেতর আসে। মণিকুন্তলা দেবী শান্ত ভাবে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বিপ্রদাসকে জরীপ করেন।

তিনি ভাবেন: ‘অল্প কিছু দিনের মধ্যে, লোকটি তাঁর প্রতিটি পছন্দ অপছন্দ জানে আর সবে’তে খেয়াল রাখে – কেউ জানে না আমার প্রতি সে কতটা যত্নশীল। ছেলেমেয়েরা এসব বুঝতে পারবে না। সৌম্যের গল্পটা হ’তে পারে আজগুবী – আবার জানি না – কিছু সত্যি লুকিয়ে আছে হয়ত! সত্যি মিথ্যের বিচার কে করবে ? কিন্তু তিনি অন্তর থেকে বোঝেন — এই লোকটি সত্যিই খুব ভালো মানুষ। নিজের জীবন বাজী রেখে প্রমাণ করতে পারেন তিনি – ঠিক, বাজী রাখতে পারেন!”

 “বিপ্রদাস, সৌম্য ঘুরতে ঘুরতে বারাসাতের কাছে একটা গ্রামে গিয়েছিল – এখুনি সে ফিরেছে সেখান থেকে ……..।”

বলতে বলতে তিনি থেমে গিয়ে লক্ষ্য করেন বিপ্রদাসের সামান্য ভাব পরিবর্তন যা সে লুকোতে পারলো না।

“ সেই গ্রামে সৌম্য – কাউকে দেখতে পেয়েছে,” তিনি শান্ত মাপা স্বরে বলেন।

তাঁর মনে হলো – ‘বিপ্রদাস যেন একটু সতর্ক হয়ে উঠেছে। তিনি নিশ্চিত বিপ্রদাস এখন বেশ সতর্ক।’

প্রথম চমকের পর, বিপ্রদাসের আবার সেই পরিচিত নির্বিকার হাবভাব,  কিন্তু স্থির  দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে, সেই দৃষ্টিতে এমন কিছু রয়েছে যা তিনি আগে কখনো দেখেন নি। এই প্রথম তাঁর মনে হলো ওই অদেখা চাউনী কখনোই খানসামার হ’তে পারে না, এই দৃষ্টি একজন পুরুষের।

কয়েক মুহূর্ত বিপ্রদাস ইতস্তত: করে। এরপর তার গলার স্বরে যেন  পরিবর্তন লক্ষ্য করেন –

“ মণিকুন্তলা দেবী – আমাকে এসব কেন বলছেন?”

তাঁর উত্তর দেওয়ার আগেই, ঘরের দরজা জোর ধাক্কায় খুলে, সৌম্য হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে আসে। তার সঙ্গে আসে আর একজন পুরুষ্ট গোঁফধারী, অমায়িক হাবভাবের  মাঝবয়সী লোক।

“ এই দ্যাখো মা-” – সৌম্য উত্তেজিত হয়ে বলে –“ ইনি হলেন আসল বিপ্রদাস। আমি আজ সকালে বারাসাত থেকে ফেরার সময় এনাকে সঙ্গে নিয়ে এসে রাস্তায় চা’য়ের দোকানে অপেক্ষা করতে বলেছিলাম।“ এবার সৌম্য সঙ্গে আসা লোকটিকে বলে– “ বিপ্রদাস, এই সামনে দাঁড়ানো লোকটাকে ভালো করে দেখ – এই লোকটা কি সেই অন্যায় ভাবে বরখাস্ত হওয়া বাগানের মালী বৈকুণ্ঠ ?”

সৌম্যর জয়োল্লাসিত মুহূর্ত বিশেষ দীর্ঘস্থায়ী হলো না। হঠাৎ সে  বুঝতে পারে কোথাও যেন মস্ত কিছু ভুল হচ্ছে। তার সঙ্গে আসা আসল বিপ্রদাস তখন বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আর নকল বিপ্রদাসের অসস্তির হাসি রূপান্তরিত হলো অপার মজা পাওয়ার প্রাণখোলা হাসিতে। 

তিনি এগিয়ে এসে আসল বিপ্রদাসের পিঠে চাপড় দিয়ে বলেন-

“ঘাবড়িও না বিপ্রদাস, থলি থেকে এবার বেড়ালটাকে বার করে দাও দেখি ! আমার ঠিক পরিচয় তুমি এখন বলে দিতে পার।”

আসল বিপ্রদাস নিজেকে সামলে নেয় কিছুটা।

“ যে আজ্ঞে হুজুর,” সে জড়োসড়ো হয়ে বিনীত স্বরে বলে – “ ইনি আমার মালিক সরকার সাহেব,আমাদের কর্ত্তা মশাই।”

পরমুহূর্তে পট পরিবর্তন হলো। প্রথমে অতি আত্মবিশ্বাসী সৌম্য  হতবুদ্ধি হয়ে পড়ল। ঘটনার অতি আকশ্মিকতায় তার ঝুলে পড়া মুখে, কি ঘটতে চলেছে বোঝার আগেই সে টের পায় কেউ তাকে  ধীরে পরিচালিত করছে ঘরের দরজার বাইরের দিকে – সাথে কোনো আন্তরিক গম্ভীর স্বর, সেই স্বরে কোথাও যেন পরিচিতির আভাস –

 “ বেশ বুদ্ধি করে আমাকে এই ভাবে খুঁজে বার করেছ। তোমায় তারিফ জানাই। কিন্তু সব ঠিক আছে – কারুর কোনো ক্ষতি হয়নি। এখন তোমার মা’র সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। .

সৌম্য, সিঁড়ির পাশে হতভম্ব হয়ে ঘরের বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে। হতবিহ্বল আসল বিপ্রদাস তার পাশে দাঁড়িয়ে – তার বুদ্ধিতে ঘটনাটা সে যা বুঝেছে, অনর্গল তার ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে। ঘরের ভেতরে রণেন্দ্র সরকার তখন মণিকুন্তলা দেবীর সম্মুখিন হয়েছেন।

 “ যতটা সংক্ষেপে পারি – আমি পরিস্থিতির ব্যাখ্যা করতে চাই। তারপর আপনি যা মনে করেন তাই করবেন।

সারাটা জীবন আমি নিজের স্বার্থদ্ধারে পাগলের মত ছুটে বেড়িয়েছি। হঠাৎই একদিন উপলদ্ধি করলাম আমার এই আত্মম্ভভরিতার পরিণাম। অনুশোচনায় ভরে উঠেছিল আমার মন। প্রায়শ্চিত্তের পথ খুঁজচ্ছিলাম। সেই সময় ঠিক করলাম-বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠানে অনুদানের পরিবর্তে,আমি  নিজেই সরাসরি কিছু করবো। আমার সবসময় খারাপ লাগতো একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর নিখাদ ভদ্রমানুষদের অবস্থা দেখে। যাঁরা নি:শব্দে দারিদ্র, দু:খ কষ্ট সহ্য করেন কিন্তু সরাসরি অর্থ সাহায্য নিতে অপমানিত বোধ করেন। আমার অনেকগুলো বাড়ি, ফ্ল্যাট  আছে এই শহরে। ঠিক করলাম আমার বাড়িগুলি নাম মাত্র টাকায় ভাড়া দেব সেই শ্রেণীর অভাবী ভদ্র মানুষদের যাঁরা অভাবে পড়েও নিজেদের আত্মসম্মান বিসর্জন দেন না। যেমন ধরুন সবে জীবন শুরু করতে চলেছে এমন তরুণ দম্পতি অথবা স্বামীহারা কোনো মহিলা, যাঁর ছেলেমেয়েরা সবে জীবনে দাঁড়ানোর কঠিন সংগ্রাম শুরু করছে।

আমার কাছে ওই বিপ্রদাসের স্থান খানসামার থেকে অনেক উঁচুতে – সে আমার বন্ধুর মত। ওর সঙ্গে আলোচনা করে, সম্মতি নিয়ে – ওর চরিত্রটা, বলতে পারেন আমি ধার করি। শুনে হাসবেন না, আমি ছোটবেলায় স্কুল কলেজে নাটক করতাম। সেদিন অনেক রাতে ক্লাব থেকে ফেরার সময়  একটি উপায় মাথায় আসে। সঙ্গে সঙ্গে বিপ্রদাসের কাছে গিয়ে তার সাথে আলোচনা করে সব ঠিক করে ফেলি। আমার বাস্তব জীবনে অভিনয় আরম্ভ হলো। তারপর দেখলাম আমার নিরুদ্দেশ নিয়ে বড় হইচই শুরু হয়েছে। উপায় না পেয়ে, তখন আমি পুলিশ আর আমার সলিসিটর কে সব জানিয়ে চিঠি পাঠাই। এই হলো আমার গত দেড় বছরের স্বল্প ইতিহাস।

তিনি দুষ্টুমি করে ধরা পড়ে যাওয়া করুণ চোখে তাকিয়ে থাকেন মণিকুন্তলা দেবীর দিকে। তিনি তখন সোজা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে স্থির দৃষ্টিতে  রণেন্দ্র সরকারের দিকে তাকিয়ে আছেন।

 “ আপনার পরিকল্পনাটা খুবই মানবিক,” মণিকুন্তলা দেবীর শান্ত স্বর-“আবার খুবই অদ্ভুত। আপনাকে বাহবা দেওয়া উচিত। আপনার কাছে আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ থাকবো চিরটাকাল। অবশ্য আপনিও বুঝতে পারছেন এই পরিস্থিতে আমাদের হয়ত আর এখানে থাকা সম্ভব হবে না।

 “আমি ঠিক এই রকম কিছু প্রত্যাশা করছিলাম,” সরকার সাহেবে ম্লান স্বর। “ সব শুনে আপনার আত্মসম্মান বাধা দেবে এই বাড়িতে থাকতে – বুঝতে পারছি আপনি কিছুতেই কারুর দাক্ষিন্য স্বীকার করতে রাজী হবেন না।

 “ দাক্ষিন্য কথাটাই তো ঠিক – তাই  কি’না ?” মণিকুন্তলা দেবী একটু কঠিন স্বরে বলেন। 

 “ না, দাক্ষিন্য নয় – কারণ পরিবর্তে আমি কিছু চাইছি আপনার কাছে।”

 “পরিবর্তে কিছু চাইছেন, মানে?”

 “ সব কিছু।”  সরকার সাহেবের চিরকালের অভস্থ্য আধিপত্যের স্বর গমগম করে ওঠে।

 “ আমার যখন তেইশ বছর বয়স,” সরকার সাহেব বলে চলেন,” আমি একজন কে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম। সে মারা গেলো ঠিক এক বছর পর। সেই সময় থেকে আমি ভীষন একা। অনেক পরে আমি ভেবেছিলাম যদি এমন কাউকে পাই, যে সত্যিকারের সম্ভ্রান্ত মহিলা –  আমার  স্বপ্নের মানুষকে—– ”

 “আমাকে কি সেই রকম মনে হয়?” মণিকুন্তলা দেবীর অবাক বিহ্বল স্বর কিছুটা ম্লান শোনায় –“ আমার বয়স হয়ে গেছে, ছেলেমেয়েরা আছে, তা’ছাড়া  ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।”

সরকার সাহেব হেসে ওঠেন –

“বয়স হয়ে গেছে? আমার মনে হয় ছেলেমেয়ের থেকে তুমি অনেক তরুণ। বলতে পারো আমার বয়স হয়ে গেছে।”

এবার মণিকুন্তলা দেবীর  হাসি ঘরের পুরনো দেওয়ালে দেওয়ালে প্রতিধ্বনীত হয়। স্নিগ্ধ হাসির লহরী – খুশির ছোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে সারা ঘরময়।

তোমার বয়স হয়ে গেছে ? আমার মনে তুমি এখনো বাচ্ছা ছেলেই আছো যে এখনো নানা পোষাকে সেজে থাকতে ভালোবাসে।”

মণিকুন্তলা ধীর পায় এগিয়ে এসে – রণেন্দ্র সরকারের হাতে ধরা পড়লেন….।

হঠাৎ ঘরের দরজা হাট হয়ে খুলে যায়। যৌথ হাসির আওয়াজে বিশ্মিত চোখে একে একে ঘরে আসে রঞ্জনা, গৌতম আর সৌম্য। সরকার সাহেবের আলিঙ্গনাবদ্ধ অবস্থায় মণিকুন্তলা দেবীকে দেখে, তাদের মুখের ভাব ক্রমশ পরিবর্তিত হয়ে খুশিতে ঝলমল করে ওঠে। রঞ্জনা দৌড়ে এসে মা’কে জড়িয়ে ধরে। সমাবেত আনন্দোচ্ছাস ও এক সাথে সবারই কিছু বলার চেষ্টায় ঘর গমগম করে ওঠে। আসল বিপ্রদাস তার পুরুষ্টু গোঁফের ফাঁকে হাসি চাপার ব্যর্থ প্রচেষ্টায় মাথা নিচু করে হাত কচলায়।

Based on Aghatha Christie’s Listerdale Mystery

-Advertisement-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here